Colorgeo

Classroom for Geology and Disaster

নিভু প্রদীপ

Spread the love

নিভু প্রদীপ

নিভু প্রদীপ লিখেছেন রাইহান

———–
রাবেয়ার স্বামী নেয়ামত আলির তিন চার দিন ধরে জ্বর, কাজে যেতে পারছে না। তিনি ভ্যান গাড়ি করে ঝালমুড়ি, বুট ভাজা, চানাচুর মাখা এসব বিক্রি করতেন। ঘরে জমানো টাকা যা ছিলো তা প্রায় শেষ। রাবেয়া ভাবছে, কাল সে নিজেই ভ্যান গাড়ি নিয়ে বের হবেন।

আশার আলো সমিতির কিস্তি দেয়ার জন্য কুলসুম ভাবির থেকে পাঁচশ টাকা ধার এনেছিলো রাবেয়া। মঙ্গলবার ফেরত দেওয়ার কথা ছিলো কিন্তু দিতে পারে নাই, বলেছে শুক্রবার দিবে। আজ শুক্রবার, বসে বসে টাকা গুনতেছে। মোট ৪৫০ টাকা হলো, আরো পঞ্চাশ টাকা দরকার। বিছানার নিচে, কাপড়ের ভাঁজে, আলমারির ভেতর অনেক খুঁজেও একটা টাকা পেলো না।
রতন জিজ্ঞেস করলো, মা তুমি কি খুঁজতেছো?
রাবেয়া বললো, সব মিলিয়ে মোট ৪৫০ টাকা হলো। আর পঞ্চাশ টাকা হলেই কুলসুম ভাবির টাকাটা দিতে পারতাম। ঔদিন টাকা দেওয়ার কথা ছিলো, দিতে পারি নাই। আজও যদি দিতে না পারি তাহলে কুলসুম ভাবির কাছে আমার মুখ থাকবে না রে।
রতন, ৫ম শ্রেণিতে পড়ে৷ বয়স দশ-বারো বছর হতে পারে। স্কুলের টিফিনের টাকা থেকে কিছু টাকা বাঁচিয়ে তার বোতলের ব্যাংকে জমা রাখে।
রতন বললো, আমার কাছে কিছু টাকা আছে, পঞ্চাশ টাকা হতে পারে, তুমি চাইলে নিতে পারো।
-তুই টাকা পাইছোস কই?
আমি জমাইছিলাম, এ বলে রতন তার বোতলের ব্যাংকটি নিয়ে আসলো। তার পর ঔটা কেটে কিছু পয়সা বের করলো, পাঁচ টাকা, দুই টাকার কয়েন। সব মিলিয়ে পঞ্চাশ টাকার বেশি হলো।

রাবেয়া মোট পাঁচশ টাকা নিয়ে কুলসুম ভাবির বাসায় দিকে বের হয়ে গেলো, বেশি দূরে না, চার পাঁচ মিনিটের পথ।
রাবেয়া হাতটেছে আর মনে মনে ভাবতেছে, আজ তো কিছুই বাজার করা হয় নাই, ভাত রান্না করা আছে। কিন্তু কোনো তরকারি নেই। রতনকে সে কি দিয়ে ভাত দেবে? ঘরে তো আর কোনো টাকা নেই, একবার ভাবলো কুলসুম ভাবির টাকা টা আজ দেবে না, কিন্তু আজ টাকা না দিলে তাকে অনেক অপমানিত হতে হবে। হাঁটতে হাঁটতে রাবেয়া, কুলসুম ভাবির বাসায় পৌঁছে গেলো। কলিং বেল টিপতেই একটা মেয়ে দরজা খুলে দিলো। মেয়েটি এ বাসায় কাজ করে। কিন্তু চাল-চরণ, ব্যাবহার, পোশাক দেখে অন্য কেউ বুঝতেই পারবে না যে ও কাজের মেয়ে।
রাবেয়া জিজ্ঞেস করলো, কুলসুম ভাবি কোথায়?
মেয়েটি বিনয়ী ভঙ্গিতে বললো, ছোটো ভাইজান কে ভাত খাওয়াইতেছে, আপনি ভেতরে আসুন।
কুলসুম ভাবি তার ছেলেকে ভাত খাওয়াতে ব্যস্ত। ছেলেটির বয়স সাত কিংবা আট হবে। চেহারা সুন্দর এবং মোটা হওয়ার কারণে বয়স আরো বেশি মনে হচ্ছে। এ ছেলে কে খাইয়ে দেয়ার মত কিছু নেই। কিন্তু কুলসুম ভাবি খাইয়ে দিচ্ছে। প্লেটে ভাত, মাছ, মুরগী, ডিম সবই আছে। তার ছেলে খেতে চাচ্ছে না, ভাবি জোর করে খাওয়াচ্ছে। রাবেয়াকে দেখেই কুলসুম ভাবি বলল, আপনার অপেক্ষাতেই ছিলাম। টাকা টা কি এনেছেন?
জ্বি, ভাবি। টাকা নিয়েই এসেছি।
কুলসুম ভাবি নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বাচঁলাম, আজ টাকা না দিলে আমার সমস্যা হয়ে যেতো। আপনার ভাইয়ের কাছে সব টাকার হিসেব দিতে হয়। আপনাকে টাকা ধার দিছি তা জানায় নাই। যদি জানতে পারতো তাহলে আমার সাথে রাগারাগী শুরু করে দিতো।
একটু বসেন ভাবি, ছেলেটাকে খাওয়ানো শেষ করি। ওকে নিয়ে আমার যত জ্বালা, একদম খেতেই চায় না।
-পৃথিবীর সবচেয়ে কষ্ট কি জনেন? ছেলে মেয়েদের খাবার খাওয়ানো।
-ওহ, হতে পারে। কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে বেদনাদায়ক কি জানেন? মা হয়ে সন্তানকে খাবার দিতে না পারা।
কিছু মনে করবেন না ভাবি, একটু তাড়া আছে, আমাকে যেতে হবে। রতনের বাবা অসুস্থ। এ বলে রাবেয়া টাকাটা কুলসুম ভাবির পাশে টেবিলের উপর রেখে চলে আসলো। আসার সময় পুকুর পাড়ের কচু গাছ গুলো থেকে কিছু কচুপাতা ছিঁড়ে নিলো। এগুলো ভাজি করে খাওয়া যাবে। যদিও অনেক গলা চুলকাবে কিন্তু তাতে কি? পেট তো ভরবে।

নেয়ামত আলির জ্বর কিছুতেই কমছে না, ফার্মেসী থেকে প্যারাসিটামল এনে খাইয়েছিলো, ওষুধ খেলে জ্বর একটু কমে কিন্তু পুরোপুরি কমে না। খাবার দাবার কিছুই খেতে পারে না। শরীরের অবস্থা এমন হয়েছে যে, দেখলে মনে হয় ৭০ বছরের বুড়ো।
সকাল ১০ টা দিকে রাবেয়া, নেয়ামত আলিকে জোর করে অল্প একটু ভাত খাইয়ে দিলো। তার পর ওষুধ খাইয়ে দিলো। রতন কে বললো, বাবার কাছে থাকতে। মাঝে মাঝে মাথায় পানি দিয়ে দিতে।
রাবেয়া ভ্যান গাড়িতে মুড়ি চানাচুর সব কিছু গুছিয়ে নিচ্ছে। ভ্যান গাড়ি নিয়ে বের হবে।

নিভু প্রদীপ
নিভু প্রদীপ

নেয়ামত আলি ডেকে বলে,
-রাবেয়া কি করছো?
-কিছু না একটু গাড়ি টা নিয়ে বের হবো।
-কি বলো, তুমি পারবে না।
-না পারি চেষ্টা তো করতে পারি, ঘরে বসে থাকলে তো কেউ টাকা দিয়ে যাবে না।
-আচ্ছা, রতন কে সাথে নিয়ে যাও।
-না, তুমি অসুস্থ, তোমাকে একা রেখে যাবো না।
-আমার সমস্যা নেই, এখন একটু ভালো লাগতেছে, তুমি রতন কে নিয়ে যাও।
রাবেয়া রতন কে নিয়ে বের হয়ে গেলো। রাবেয়া ভ্যানের হাতল ধরেছে, রতন পিছন থেকে গাড়িটা ঠেলতেছে। বাজারে এক পাশে তারা ভ্যান রেখে, সামনে কাস্টমার বসার জন্য ৩ টা টুল সাজিয়ে দিলো। কাস্টমার আসলে রাবেয়া ঝালমুড়ি বানিয়ে দিচ্ছে আর রতন সেগুলো কাস্টমারের কাছে দিয়ে আসে, আর টাকা নেয়। দুপুর পর্যন্ত তাদের বেচাকেনা ভালোই হলো। বাসায় ফিরে আসার সময় তারা বাজার থেকে কিছু কাঁচা বাজার করে আনলো রান্না করার জন্য। নেয়ামত আলির জ্বর বেড়েছে, শরীরে হাত দেয়া যায় না, আগুনের মতো গরম। রাবেয়া তাকে ভেজা গামছা দিয়ে পুরো শরীর মুছিয়ে দিতে দিতে বললো,
-চলো তোমায় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই।
নেয়ামত আলি অবহেলার ভঙ্গিতে বললো,
-ডাক্তার কি করবো? সেই তো নাপা ওষুধ ই দিবো। জ্বরের জন্য নাপা খায় তা সবাই জানে। তার আগে বলো তোমার বেচাকেনা কেমন হলো? কোনো সমস্যা হয় নাই তো?
-নাহ, বেচাকেনা আলহামদুলিল্লাহ, ভালোই হইছে।
-ও আচ্ছা, বিকেল বেলা বেশি বেচাকেনা হয়। তখন সবাই ঘুরতে বের হয়। বাজার করেছো কি?
-১ কেজি পেপে আর লাল শাঁক।
-ওহ, অল্প করে চিংড়ি মাছ আনতে, পেপে দিয়া চিংড়ি মাছের তরকারি অনেক ভালো লাগে।
-আচ্ছা, বিকালে বের হলে নিয়া আসবো, তারপর রাতে পেপে দিয়ে চিংড়ি মাছ রান্না করবো, এখন আমি লাল শাক ভাজি করি। তুমি শুয়ে থাকো।
রতন কে বলবো মাথায় পানি দিয়ে দিতে৷
রাবেয়া, নেয়ামত আলির কপালে ভেজা কাপড় দিয়ে রান্না ঘরে চলে গেলো।

বিকাল ৪ টার দিকে রাবেয়া ভ্যান গাড়ি নিয়ে বের হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, নেয়ামত আলির জ্বর অনেকটা কমে গেছে, বিছানায় বসে রতনের সাথে কথা বলতেছে। রতনকে শিখিয়ে দিচ্ছে কিভাবে ঝালমুড়ি বানালে বেশি টেস্ট হয়। রতন, নেয়ামত আলির থেকে ঝালমুড়ি বানানো সব কৌশল শিখে ফেলেছে। রাবেয়া যখন বের হবে তখন নেয়ামত আলি ডেকে বললো,
-আজ আর বের হওয়ার দরকার নেই আবার কাল যেও।
রাবেয়া বললো,-এইতো সন্ধার আগেই চলে আসবো। তুমি একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো।

রতন কে নিয়ে রাবেয়া চলে গেলো। এই দিকে নেয়ামত আলির জ্বর প্রচন্ড বেড়ে গেছে। কখনো হুশ হয় কখনো বেহুশ। সন্ধ্যার সময় রাবেয়া আর রতন আধা কেজি চিংড়ি মাছ নিয়ে বাসায় ফিরলো। দরজা খুলতেই নেয়ামত আলিকে দেখলো ঘরের মেঝেতে উপুর হয়ে পড়ে আছে।
রাবেয়া তারাতাড়ি ছুটে গিয়ে নেয়ামত আলিকে কোলে নিয়ে ডাকা ডাকি করতে লাগলো কিন্তু কোনো সাড়া নেই, আগুনের মতো গরম শরীর টা বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে আছে। রতন, বাবা,বাবা করে ডেকে যাচ্ছে কিন্তু কোনো উত্তর নেই। নিথর দেহটা রাবেয়ার কোলে পড়ে আছে।

রাইহান
শিক্ষাবর্ষঃ ২০১৯-২০
ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রকাশিত: ‘বর্ণালী’ মাসিক ম্যাগাজিন, অক্টোবর সংখ্যা, ২০২০

 

সফল হওয়ার উপায়: 2 টি বাস্তব গল্প