Colorgeo

Classroom for Geology and Disaster

Spread the love

সুন্দরবন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ


সুন্দরবন হলো বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত একটি প্রশস্ত বনভূমি যা বিশ্বের প্রাকৃতিক বিস্ময়াবলির অন্যতম। পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীত্রয়ের অববাহিকার বদ্বীপ এলাকায় অবস্থিত এই অপরূপ বনভূমি বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দুই জেলা উত্তর চব্বিশ পরগনা ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জুড়ে বিস্তৃত।

সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে সুন্দরবন বিশ্বের সর্ববৃহৎ অখণ্ড বনভূমি। ১০,০০০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার (৬২%) রয়েছে বাংলাদেশে এবং বাকি অংশ (৩৮%) রয়েছে ভারতের মধ্যে।

উদ্ভিজ্জ  সুন্দরবনের গাছপালার অধিকাংশই ম্যানগ্রোভ ধরনের এবং এখানে রয়েছে বৃক্ষ, লতাগুল্ম, ঘাস, পরগাছা এবং আরোহী উদ্ভিদসহ নানা ধরনের উদ্ভিজ্জ। অধিকাংশই চিরসবুজ হওয়ার কারণে এদের সবার শারীরবৃত্তিক ও গঠনগত অভিযোজন কমবেশি একই রকম। অধিকাংশ বৃক্ষের আছে ঊর্ধ্বমুখী শ্বাসমূল যার সাহায্যে এরা শ্বসনের জন্য বাতাস থেকে সরাসরি অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারে।

এ বনের প্রধান বৃক্ষ প্রজাতি সুন্দরী এবং গেওয়া। ১৯০৩ সালে ডি. প্রেইন সুন্দরবনের গাছপালার উপর লিখিত তাঁর গ্রন্থে ২৪৫ গণের অধীনে ৩৩৪টি উদ্ভিদ প্রজাতি লিপিবদ্ধ করেছেন; এর মধ্যে ১৭টি ফার্নজাতীয়  ৮৭টি একবীজপত্রী  এবং অবশিষ্ট ২৩০টি দ্বিবীজপত্রী। প্রজাতিগুলির মধ্যে ৩৫টি শিমগোত্রীয়, ২৯টি তৃণজাতীয়, ১৯টি হোগলাজাতীয় এবং ১৮টি সিজজাতীয় উদ্ভিদ অন্তর্ভুক্ত। আজ পর্যন্ত জানা প্রায় ৫০টি প্রকৃত ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ প্রজাতির মধ্যে কেবল সুন্দরবনেই আছে ৩৫টি প্রজাতি। অধিকাংশ ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ চিরসবুজ, খাটো, গুল্মজাতীয় অথবা লম্বা বৃক্ষজাতীয়। এদের অনেকেই বনের তলদেশ খালি না রেখে সাধারণত দলবদ্ধভাবে জন্মায়।

সুন্দরবন
ফটোঃ সুন্দরবনের বাঘের নিরাপদ স্থান।

ভূতত্ত্ব  উৎপত্তির দিক থেকে সুন্দরবনের ভূভাগ সাম্প্রতিককালের এবং হিমালয় পর্বতের ভূমিক্ষয়জনিত জমা পলি থেকে এর সৃষ্টি। ভূগঠন প্রক্রিয়াটি সাগরের জোয়ারের কারণে ত্বরান্বিত হয়েছে। এর নিম্নস্তর প্রধানত কোয়াটারনারি যুগের তলানিতে গঠিত, যার সংমিশ্রণ ঘটেছে বালি, পলি, সামুদ্রিক লবণ এবং কাদামাটির সঙ্গে। ভূতত্ত্ববিদগণ এখানকার ভূগঠনবিন্যাসে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে সামান্য ঢালের সন্ধান পেয়েছেন এবং সেসঙ্গে টারসিয়ারি সময়ে সংঘটিত বাংলার অববাহিকার ঝুকানো অবস্থা শনাক্ত করেছেন।

দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে সংঘটিত নব্য-ভূগঠনিক আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে বেঙ্গল বেসিন পূর্বমুখে ঝুঁকে পড়ে। সন্ধানমূলক কূপ খনন গবেষণা থেকে প্রতীয়মান হয় যে সুন্দরবনের পশ্চিম এলাকা অপেক্ষাকৃত সুস্থিত হলেও দক্ষিণ-পূর্ব কোণার অংশ একটি সক্রিয় পলিজ এলাকা এবং ক্রমে তা নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে।

এছাড়াও সুন্দরবন আমাদের ননান ভাবে সাহায্য করে থাকে।

যদি এই সুন্দরবন না থাকতো, তাহলে বাংলাদেশ অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়ে যেত। কেননা এই সুন্দর বন প্রতি বছর অনেক বড় বড় ঝড়,ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদির মতো পাকৃতিক সূযোগের সাথে মোকাবেলা করে আমাদের অস্তিত্ব ঠিকিয়ে রেকেছে।আর এর ফলে প্রত্যেক বছর এই সুন্দরবনের প্রায় ৪০% ক্ষতি হয়। শুধু তাই নয় এই সুন্দর বন আমাদের জন্য আশ্বীরবাদ স্বরুপ এই এলাকার গৃহহীন অনেক মানুষ এই বন থেকে জীবিকা নির্ভর করে।

পাশাপাশি এই বন থেকে কাঠ সংগ্রহ করেও অনেকে জীবিকা নিভর্র করে।সুন্দর বন যেই ভাবে আমাদেরকে পাকৃতিক সূযোগ থেকে রক্ষা করে এটা অতুলনীয় যা অন্য কোন কিছু দিয়ে এই দূযোগ মোকাবিলা করা খুব কষ্ট সাধ্য বিষয়। সর্বপরি আমরা যদিও আমাদের এই বনকে সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব একান্তই আমাদের। এর পাশাপাশি আমরা আমাদের স্থানীয় প্রশাসনকে অবগত করতে পারি যাতে এই বনের অস্তিত্ব ঠিক থাকে।

গাছপালা কেউ যেন অপ্রয়োজনে না কাটে। এ ছাড়াও এই বনে অনেক প্রাণি আছে যা এখন সারা বিশ্বেও বিরল। কোথাও দেখা যায় না বললেই চলে।

এছাড়াও আমাদের জাতীয় পশু রয়েল বেঙ্গল টাইগার এই বনেই বসবাস করে।

তাই আমাদের এই অরিন্দম সুন্দর যা বৃহওর পৃথিবীর তিনটির মধ্যে একটি আমাদের এই সুন্দরবন।  যা আমাদের জাতিসত্বার পরিচয় বহন করে এছাড়া নানানভাবে আমাদের পাকৃতিক সূযোগ থেকে রক্ষা করে তাই এটিকে আমরা আমাদের সবটা দিয়ে রক্ষা করার দায়িত্ব একান্তই আমাদের।

সুন্দরবন হল বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় অঞ্চল বিশেষ করে খুলনা বাগেরহাট বরগুনা সাতক্ষীরা এই জেলাগুলোর কিছু অংশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দুটি জেলা বিশেষ করে উত্তর ২৪ পরগনা এবং দক্ষিণ 24 পরগনা একটি বিস্তৃত অঞ্চল। সমুদ্রের নোনা পরিবেশে বনভূমিতে সাধারণত যে গাছপালা জন্মে তাকে বলা হয় ম্যানগ্রোভ। 

সুন্দরবনের আয়তন ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার এবং এর মধ্যে ৬৫১৭ বর্গ কিলোমিটার বাংলাদেশের অংশ এবং বাকি অংশ ভারতের মধ্যে রয়েছে। ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ইউনেস্কো সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং এই তালিকায় নামকরণ করা হয়েছে সুন্দরবন।ইউনেস্কো ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে মূলত ভারত এবং বাংলাদেশের অংশকে দুইটি আলাদা আলাদা নামে সুন্দরবন জাতীয় উদ্যান ও সুন্দরবন। 

সুন্দরবন
সুন্দরবনের কুমির

২০২০ সালের মূল্যায়নে বিপন্ন কিন্তু আন ইউ সি এন রেড লিস্ট অফ ইকো সিস্টেমওয়ার্কের অধীনে ভারতীয় অংশের সুন্দরবনকে বিপন্ন হিসেবে ধরা হয়েছে।  সুন্দরবনে মোট বনভূমির ৩১.১ শতাংশ জুড়ে রয়েছে নদী নালা বিলসহ জলাকীর্ণ অঞ্চল। বনভূমিটিতে পৃথিবী বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার সহ অন্যান্য ধরনের প্রাণী যেমন চিত্রাহীন রয়েছে। সুন্দরবনের প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক ঘুরতে আসে । যদিও সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে, মানুষ সৃষ্ট বিভিন্ন পরিবেশ হুমকিমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে। সুন্দরবনের অপরূপ সৌন্দর্য প্রকৃতিপ্রেমীকে সর্বদাই টানে। ২৯০ টি পাখি একশ কুড়ি টি মাছ প্রজাতি ৪২ টি স্তন্যপায়ী ৩৫ টি বিভিন্ন রকম সরীসৃপ এবং আটটি উভচর প্রজাতি সহ ৪৫৩ টি প্রাণী সমৃদ্ধ   করেছে সুন্দরবনকে।

সুন্দরবন কিভাবে আমাদের রক্ষা করে:

সুন্দরবন বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের দক্ষিণ ভূখণ্ডকে রক্ষা করে। ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ভূমিধসের কারণে প্রায় ৪০% সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তাছাড়া সমুদ্রের জল স্তর কমে যাওয়ার কারণে বনটির ক্ষতিসাধন হয়েছে। ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলাতে সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছিল। 

বর্তমানে সুন্দরবন এলাকায় পরিচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিশেষ করে কয়লা চালিত রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বাংলাদেশের বাগেরহাট জেলার অবস্থিত। ইউনেস্কোর একটি প্রতিবেদন বলা হয় যে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হলে সুন্দরবনের অনেক ক্ষতিসাধন হবে ।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে সুন্দরবনঃ

বাংলায় সুন্দরবনের আক্ষরিক অর্থ সুন্দর জঙ্গল অর্থাৎ সুন্দর বনভূমি। সাধারণত মনে করা হয় সুন্দরবনের অবস্থিত বিপুল পরিমাণ সুন্দরী গাছ এর থেকেই সুন্দরবনের নামকরণ করা হয়েছে। যদিও এই নামকরণ নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে । কারণ সঠিক কোন তথ্য প্রমাণ আসলেই সৌন্দর্যের এই  দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে হয়ত যুক্তি যুক্ত হতে পারে।

সুন্দরবন
সুন্দরী গাছ

মুঘল আমলে অর্থাৎ ১২০৩ সাল থেকে ১৫৩৮ সালে একজন স্থানীয় রাজা সুন্দরবনের ইজারা আনেন এবং তার পর থেকেই সুন্দরবন বিশ্বের মধ্যে ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে স্বীকৃতি পেতে থাকে এরপরে ১৭৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক মুঘল সম্রাটদের কাছ থেকে পাওয়ার পরে একটি মানচিত্র তৈরি করা হয়।

১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন ভারতীয় বাংলা প্রদেশের বন বিভাগ স্থাপনের পরে বনাঞ্চলটি একটি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ভূখণ্ড হিসেবে পরিচালিত হতে থাকে।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে সুন্দরবনের আয়তন দ্বিগুণ ছিল কিন্তু মানুষের ক্রমবর্ধমান চাপে এবং মানুষের সৃষ্ট বিভিন্ন কর্মকান্ডে বনটির আয়তন সংকুচিত হতে থাকে এবং জীববৈচিত্রের উপর অনেক প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। ১৮৭৮ সালে সমগ্র সুন্দর সুন্দরবন এলাকাতে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগের সময় সুন্দরবনের ৬৫১৭ বর্গ কিলোমিটার বাংলাদেশের অংশে পড়ে এবং বাকি অংশটা ভারতের অংশে পড়ে।

সুন্দরবনের বাঘের বর্তমান অবস্থা:

 ২০০৪ সালের হিসাব মতে সুন্দরবনের প্রায় ৫০০টি রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছিল । সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার প্রতিবছর করে ১০০ থেকে ২৫০ জন মানুষকে মেরে ফেলে এবং এ কারণেই রয়েল বেঙ্গল টাইগার খুব বেশি পরিচিত। রয়েল বেঙ্গল টাইগার সাধারণত মানুষের বাসস্থান সীমার মধ্যে যেতে পছন্দ করে না তবে বাঘের অভয়ারণ্যের চারপাশে মানুষের উপর আক্রমণ ও বিরল।  সুন্দরবনের ভারতীয় অংশে নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়ায় সেখানে বাঘের আক্রমণে একটি মানুষের ও মৃত্যুর খবর পাওয়া যায় না । অন্যদিকে বাংলাদেশের সুন্দরবনের ভূখণ্ডে ১৯৮১ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত অর্ধশতাধিকর বেশি বাঘ মানুষের হাতে মারা গেছে। 

বিশ্বের সবচেয়ে বড় নিরাপদ সীমা ব্লকের ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন বাংলাদেশে অবস্থিত।  বাংলাদেশে এই ম্যানগ্রোভ বাস্তু সংস্থানটি এখন সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে।  প্রাকৃতিক সম্পদের ঋণাত্মক ও এনট্রোপনিক প্রভাব এবং মাত্রাধিক্য সম্পদ আহরণ করার জন্য এই বাস্তুসংস্থানটি মারাত্মক ক্ষতির সাধিত হয়েছে।  সীমিত বিকল্প জীবন যাপনের সুযোগ এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি জনিত কারণে সুন্দরবনটি আজ হুমকির মুখে বাংলাদেশের ম্যানগ্রোভ বনে চিংড়ি মাছ চাষ অতি দ্রুত বৃদ্ধি বৃদ্ধি পাওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ হুমকির কারণ বেআইনি গাছ কেটে ফেলার কারণে অথবা বেআইনি বন্যপ্রাণী ধরা এবং বন এলাকায় বেআইনিভাবে অধিগ্রহণ করার কারণে এই বনটি এখন উদ্বেগ জনক ভাবে জীব বৈচিত্র হারাচ্ছে।

এই ইকো সিস্টেমটির চরমভাবে পরিবর্তন করতে পারে জলবায়ু পরিবর্তন এবং বিশেষভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চ বৃদ্ধি । একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে বাংলাদেশের সমুদ্র সুন্দরবনের ক্রমাগত ধ্বংস হয়ে যাওয়ার এর মূল কারণহিসাবে  সনাক্ত করা হয়েছে এবং সেখানে বলা হয়েছে যে উন্নত সিলভী কালচার উন্নত বৈজ্ঞানিক গবেষণা র মাধ্যমে টেকসই প্রযুক্তি ব্যবহার করলে সুন্দরবনের জীব বৈচিত্র্য রক্ষা করা যাবে।

সুন্দরবন
ফটোঃ কুমির

সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বন ধ্বংসের কারণঃ

সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বন ধ্বংসের কারণ হিসাবে দুইটা কারণ প্রধান কারণ হিসাবে ব্যাখ্যা করা যায়। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে কারণ দুইটি হল

১। মানব সৃষ্ট কারণ

2. প্রাকৃতিক কারণ

৩। অনন্য কারণ

১। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বন ধ্বংসের  মানব সৃষ্ট কারণঃ

ক) অধিক হারে বৃক্ষ নিধন ও অবৈধ ভাবে গাছ কাটা;

মানুষের উন্নয়নের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে অধিক হারে বৃক্ষ নিধন করে বন উজাড় করে ফেলছে। অনেক সময় অবৈধ ভাবেও গাছ কাটা হয় যা কিনা সুন্দরবনের জন্য বিরাট হুমকি স্বরূপ ।অবৈধ ভাবে গাছের গুড়ি কেটে অথবা জালানি ব্যবহার হিসাবে গাছ কেটে বন উজাড় করছে স্থানীয় মানুষ। এর অন্যতম প্রধান কারণ হল স্থানীয় মানুষের বেকার ও চাকুরী অথবা কর্মসংস্থান না থাকা যার ফলে তারা বাধ্য হচ্ছে সুন্দরবনের গাছ অবৈধ ভাবে কেটে জীবীকার সন্ধান করা।

তাছাড়া খুলনা শহরের অদূরে কাগজ কল থাকার কারণে ঐ কর্তন কৃত গাছ বিক্রি করতেও অনেক সুবিধা হয় অবৈধ কারবারিদের। যদিও কাগল কল বৈধ কাঠ দিয়ে কাঁচামাল করে থাকে তবে অবৈধ ব্যবসায়ীরা গোপনে বৈধতার আড়ালে ব্যবসা করে যাচ্ছে। সুন্দরবন থেকে শুধু কাগজ কলের জন্যই গাছ কাটা হয়না । অন্যান্য কারণ যেমন রান্নার জালানি কাঠ, গবাদি পশুর খাবার সংগ্রহের জন্য , স্থানীয় ভেষজ ওষুধের জন্য , মানুষের খাবার সংগ্রহ, যেমন মধু সংগ্রহ, বন্য প্রাণী নিধন ইত্যাদি কারণে অবৈধ ভাবে বন কেটে উজাড় করা হচ্ছে। তাছাড়া জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও একটি বড় কারণ।

খ) ১।  সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বন ধ্বংসের  চিংড়ি চাষ সম্পর্কিত কারণঃ

বাংলাদেশে সুন্দরবন এর ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের আশে পাশে জেলাগুলোতে চিংড়ি চাষ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়াতে ম্যানগ্রোভ বন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে ম্যানগ্রোভ ব্যাবহার করা হচ্ছে চিংড়ি চাষে মাছ চাষে । স্থানীয় প্রায় ১৪ টি মাছ চাষের কৌশল রয়েছে।

সুন্দরবন
ফটোঃ সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ

সুন্দরবনের জীবও বৈচিত্র্য অনেক বেশি সমৃদ্ধ। এখানে রয়েছে জলজ প্রাণী ও স্থলজ প্রাণী। অন্যান্য উদ্ভিজ যেমন ফার্ন, আলজি, ব্যাকটেরিয়া, ও গুল্ম জাতীয়ও উদ্ভিজের মত ম্যানগ্রোভ একটি বহু ব্যপ্ত উদ্ভিদ। গবেষণায় দেঝা গিয়েছে যে এখানে ৩৩৪ টি উদ্ভিদ রয়েছে যার মধ্যে ৫০ টি ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ প্রজাতির। অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক বহু উদ্ভিদ রয়েছে এই সুন্দরবনে। যদিও সুন্দরবনে বিদ্যমান  প্রাণী দের ক্ষেত্রে কম গবেষণা হয়েছে। তবে FAO তার এক গবেষণায় দেখহিয়েছে যে সুন্দরবনে মোট, ৮৪০ প্রজাতির প্রাণী রয়েছে।

 সুন্দরবনের এই  সব প্রাণী গুলোর মধ্যে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ৪১৯ টি রয়েল বেঙ্গল টাইগার রয়েছে। ৫০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৩২০ প্রজাতির পাখি, ৫০ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৪০০ প্রজাতির মাছ, এবং পোকামাকড় রয়েছে। ২০ প্রজাতির চিংড়ি, ৮ প্রজাতির লবস্টার, ৭ প্রজাতির কাঁকড়া, সহ আরও অন্যান্য ঝিনুক প্রজাতিই রয়েছে।  মাছ প্রজাতির মধ্যে সাধারণত ১২০ প্রজাতির মাছ স্থানীয় জেলেরা শিকার করে থাকে। 

সুন্দরবনে অনেক ধরনের গাছ রয়েছে যা কিনা অর্থনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ম্যানগ্রোভ বোনশুধু এই নির্দিষ্ট গাছেরই প্রাচুর্যতা নেই এখানে রয়েছে আরো গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য প্রজাতির গাছ যা কিনা তা নিয়েও জনগণের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলবাংলাদেশের কচিখালী ও কাটকা এলাকাতে বিস্তৃত তাছাড়া হিরণ পয়েন্ট পাটনি দ্বীপ ও মান্দার বাড়িয়া এলাকার তে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলবিস্তৃত সুন্দরবন এ অর্থনৈতিকভাবে যেসব বৃক্ষ খুবই গুরুত্বপূর্ণ সেগুলোর মধ্যে হলো ছোট বড় কিছু গাছ যেগুলো সাধারণত জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে এবং খুলনাতে কাগজ কলের জন্য কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় তাছাড়া ঘরবাড়ির আসবাবপত্র ও ব্রিজ তৈরিতে খুবই মজবুত।

চিংড়ি উৎপাদনের জন্য চকরিয়া সুন্দরবন এলাকাটি বর্তমানে সম্পূর্ণরূপেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছে যেহেতু ১৪ ধরনের মাছ চাষের পদ্ধতি স্থানীয় জেলেরা ব্যবহার করে থাকে এর মধ্যে কিছু পদ্ধতি রয়েছে যা কিনা ম্যানগ্রোভ বনের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ সাধারণত পশ্চিমে অবস্থিত খুলনাতে শতকরা ১৯ শতাংশ সাতক্ষীরাতে ১৯ শতাংশ বাগেরহাটে ২৯ শতাংশ চিংড়ি খামার রয়েছে কক্সকক্সবাজারে চিংড়ি খামারগুলোতে প্রতিবছর ৬২০ টন ইউরিয়া এবং ১৫ টনবর্জ্য পানিতে মিশে যায়, বিশাল পরিমাণে এই রাসায়নিক দ্রব্য উপকূলীয় মৎস্য সম্পদে একটি ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করছে 14 ধরনের রাসায়নিক এবং ওষুধ ব্যবহার করা হয়।

 সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনের দূষণ এর কারণঃ 

 দিন দিন কল কারখানার উন্নয়ন কৃষি ও মৎস্য খামারের উন্নয়নের প্রতিনিয়তই বাড়ছে রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারের পরিমাণেদূষণ প্রক্রিয়াতে প্রচুর পরিমাণে কীটনাশক ও বর্জ্য ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের পানিতে মিশে যাচ্ছে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের ইকোসিস্টেম বর্তমানে একটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে বিশেষ করে তেল নিঃসরণ ভারী ধাতু কৃষি জনিত রাসায়নিক পদার্থ বিশেষ করেকৃষিজনিত কীটনাশক বিশেষ করেঅধিক পুষ্টি সম্পন্ন রাসায়নিক পদার্থ যা ম্যানগ্রোভ কোন অঞ্চলে ইকো সিস্টেমে প্রভাব ফেলছে

তেল জাতীয় দূষণের ফলে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের বিভিন্ন রকম প্রাণী ও সামুদ্রিক পাখিদের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে এই ধরনের তেল নিঃসরণের একটি উৎস হলো মংলা পোর্ট এর বড় বড় জাহাজ থেকে পেট্রোলিয়াম জাতীয় তেল সুন্দরবনের পথেপরিবহনের সময় ম্যানগ্রোভ বন অঞ্চলের পানিতে মিশে পানি দূষণ করছে নৌপথে তেল পরিবহনের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণে জীবাশ্ম তেল নিষ্কাশনের মাধ্যমে নিঃসরণের মাধ্যমে পানি দূষণ করছে তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের হেভি মেটাল ভারী ধাতু যেমন যে ক্যাডমিয়াম ক্রোমিয়াম লেট ম্যানগ্রোভ অঞ্চলের মাটিতে পাওয়া গিয়েছে।

দ্রবণের গান গ্রুপ বনাঞ্চলের ব্যবস্থাপনা ত্রুটির কারণেও ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল হুমকির মুখে রয়েছে এর মধ্যে তিনটি প্রধান যে কারণ সেগুলো হলো দক্ষ ও প্রশিক্ষিত অফিসারের অভাব উপকূলীয় সম্পদ রক্ষার জন্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ব্যর্থতা তাছাড়া অদক্ষ পরিকল্পনা এবং সীমিত জ্ঞানেরপ্রভাবে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বন অঞ্চলের সামগ্রিক পরিবেশ আজ হুমকির মুখে।

 ম্যানগ্রোভ ইকোসিস্টেম সম্বন্ধে জ্ঞানের অপ্রতুলতা এবং স্থানীয় জনগণের উপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণে এই সমস্যা দিনদিন দিন বেড়েই চলেছে স্থানীয় জনগণ জানে না এই বরঞ্চ কিভাবে সংরক্ষণ করতে হয় বরঞ্চ তারা ধ্বংসাত্মক পথেই অগ্রগামী হয়।

ম্যানগ্রোভ পর অঞ্চল ধ্বংসের আরো একটি যে কারণ ম্যানগ্রোভ বানা অঞ্চলের ভূখণ্ড একটি প্রাকৃতিক সম্পদ জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথেই এখানে লবণ চাষ করা থেকে শুরু করে কৃষি জমি তৈরি এবং মাছ চাষের জন্য ফার্ম তৈরি শুরু হয়ে গিয়েছে অধিক পরিমাণে এই ম্যানগ্রো বন অঞ্চলের খামার তৈরি করা হয়েছে এভাবেম্যানগ্রোভ গাছের পাতাগুলো একটি উৎকৃষ্ট মানের গৃহপালিত পশুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয় স্থানীয় জনগণ তাদের ছাগল গরু মহিষ এজন্য ম্যানগ্রোভ গাছ থেকে পাতাগুলো কেটে নিয়ে যায় এভাবে ম্যানগ্রো।

 সুন্দরী গাছের রোগ ও সুন্দরবনের বন উজাড় হওয়াঃ

ম্যানগ্রোভ কোন অঞ্চলের গাছপালা ধ্বংস হওয়ার আরেকটি প্রধান কারণ হলো সুন্দরী গাছগুলো রোগাক্রান্ত হওয়া প্রতিবছর নদীর লবণাক্ততাব বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সুন্দরী গাছগুলো মারা যাচ্ছে। এবং এর ফলে বিপুল পরিমাণ গাছ মারা গিয়ে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য টা কমাতে হবে। 

ম্যানগ্রোভ বনে আগুনঃ

ম্যানগ্রোভ বনে আগুন লাগা বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্প্রতি সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনে আগুন লাগার ঘটনায় বোনের ইকো সিস্টেমে বিরূপ প্রভাব ফেলছে বিশেষ করে ঐতিহ্যবাহী রয়েল বেঙ্গল টাইগার এর বসবাসের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে 2010 সালের ২৫০ একটু জমির জায়গা নিয়ে আগুন লাগার ঘটনায় বোনের বাস্তুসংস্থানের ক্ষতি সাধিত হয়েছে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বোন হল মধু ও মম এর জন্য প্রধান উৎস মোম এবং মধু সংগ্রহের কৌশল অনেক পুরাতন না করা হয় যে ২০০ মেট্রিক টন মধু এবং ৫৫ মেট্রিক টন মোম প্রতিবছর সুন্দরবন থেকে আহরণ করা হয় । মৌচাকে মধু সংগ্রহ করার জন্য সাধারণত আগুন লাগানো হয় তাই ভুলবশত কখনো কখনো আগুনের সূত্রপাত মধু সংগ্রহের পদ্ধতিগত ত্রুটি থেকে বিস্তার লাভ করতে পারে এবং সমস্ত জ্বালিয়ে দিতে পারে। 

সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বন ধ্বংসের  প্রাকৃতিক কারণঃ

প্রাকৃতিক দুর্যোগ জলবায়ু পরিবর্তনে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বাংলাদেশের প্রতিবছরই প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হয় বিশেষ করে সাইক্লোন বন্যা ঘূর্ণিঝড় উপকূলীয় ভূমিকায় জলবায়ু পরিবর্তন এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি সাধারণত গাছপাড়া এবং প্রাণীদের দ্রুত ক্ষতিসাধন করে থাকে 142 মিলিয়ন ডলার ২৬ শতাংশ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে ।  জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয় ম্যানগ্রোভ বনের লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি স্বরূপ হয়ে দাঁড়ায় এভাবেই আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে বিবেচনায় বাস্তুসংস্থান ফসলের ক্ষতি হয়ে থাকে। ইউনেস্কোর একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে মনুষ্য সৃষ্ট কারণে 45 সেন্টিমিটার সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে।