প্রফেসর ড. জিল্লুর রহমানঃ এক আলোকিত শিক্ষকের প্রয়াণ

প্রফেসর ড. জিল্লুর রহমানঃ এক আলোকিত শিক্ষকের প্রয়াণ

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পবিপ্রবি) ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য শিক্ষার আলোকবর্তিকা, প্রিয় শিক্ষক,  অধ্যাপক ড. মো. জিল্লুর রহমান—আজ আর আমাদের মাঝে নেই।

তিনি আজ ভোর ৫টা ৫ মিনিটে ঢাকার ইবনে সিনা হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (ICU) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

জিল্লুর স্যার এর সাথে আমার সম্প্রতি দেখা হয়েছি বিশ্ব বিদ্যালয়ের ভাইস চাঞ্ছেলর স্যার এর অফিস কক্ষে। আমি যখন ভিসি স্যার কে আমার মাগুরার বাসার আছে এবং বাড়ি বলা যায় তখন প্রিয় জিল্লু স্যার আমাকে থামিয়ে বলেন এই তোমার বাড়ি ঝিনাইদহ আর তুমি বলছ মাগুরার কথা? আমি তখন বললাম স্যার মাগুরা আমাদের বেশি যোগাযোগ তাই মাগুরার কথা বলা । তাছাড়া ভিসি স্যার মাগুরাতে একটা গবেষণা করেছিলেন আমি যে সমস্ত স্পট গুলো চিনি এটা বোঝাতে মাগুরা বলা। আমার জন্ম স্থান শৈলকূপা আর জিল্লু স্যার এর হরিনাকুন্ডু ঝিনাইদহ জেলা।  এছাড়া জিল্লু স্যার এর সাথে পথে দেখা হলেই কুশল বিনিময় হত। কিন্তু নিয়তির কি নির্মম পরিহাস স্যার আজ আমাদের মাঝে নাই ভাবতেই শরীর হিম শীতল হয়ে যায়।

শিক্ষা ও গবেষণায়:

অধ্যাপক ড. মো. জিল্লুর রহমান ১৯৯৪ সালে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে বিএ (সম্মান) এবং ১৯৯৫ সালে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর শিক্ষাজীবনের এই ভিত্তিভূমি তাঁকে একজন নিবেদিতপ্রাণ গবেষক হিসেবে গড়ে তোলে।

• এমফিল গবেষণা (২০০৯): ‘Shakespearean Tragedies and Social Realism’
• পিএইচডি গবেষণা (২০২২): “The Second Generation English Romantic Poets and Kazi Nazrul Islam: A Comparative Study”

তাঁর এই গবেষণা তাঁর বিশ্লেষণী গভীরতা, সাহিত্যবোধ ও তুলনামূলক চেতনার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

পেশাগত জীবন ও প্রশাসনিক দায়িত্ব:

ড. জিল্লুর রহমান ২০০৭ সালে পবিপ্রবিতে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন এবং তাঁর মেধা ও কর্মদক্ষতা দিয়ে ধাপে ধাপে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করেন:

• প্রভাষক (২০০৭)
• সহকারী অধ্যাপক (২০০৯–২০১৪)
• সহযোগী অধ্যাপক (২০১৪–২০১৮)
• অধ্যাপক (২০১৮ সাল থেকে)

তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ও যোগাযোগ বিভাগের চেয়ারম্যান এবং ২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্র বিষয়ক উপদেষ্টা (DSW) হিসেবেও দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ স্কাউটের পটুয়াখালী জেলার রোভার স্কাউটের সিনিয়র সহসভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজেন্ট বোর্ডের সদস্য হিসেবেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। প্রশাসনিক কাজের মধ্যেও তাঁর ব্যক্তিত্ব ছিল মধুর, সংবেদনশীল এবং দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ।

গবেষণা আগ্রহ ও প্রকাশনা:

তাঁর গবেষণার আগ্রহের ক্ষেত্রগুলো ছিল বহুমাত্রিক ও গভীর: শেক্সপিয়র, ২০শ শতকের উপন্যাস, গবেষণা পদ্ধতি, ইকো-পোয়েট্রি, মানবাধিকার ও সাহিত্য, এবং নজরুল গবেষণা। তিনি দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জার্নালে প্রায় ২০টির বেশি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন। বিভিন্ন জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিক ও ম্যাগাজিনেও তাঁর লেখনী প্রকাশিত হয়েছে, যা ছিল ভাষার সৌন্দর্য ও ভাবগভীরতার এক অনুপম সম্মিলন।

উল্লেখযোগ্য গবেষণা প্রকল্পসমূহ:

• “English For Specific Purposes (ESP) at PSTU: Existing Fluxes, Challenges and Prospects” (জুলাই ২০২২ – জুন ২০২৩)
• “Expediting Students’ English Writing Skill through Performance Assessment at PSTU” (জুলাই ২০২৪ – জুন ২০২৫)

অধ্যাপক ড. মো. জিল্লুর রহমান একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক ও গবেষক হিসেবে পবিপ্রবিতে শিক্ষার্থীদের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও সহশিক্ষা কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এক দীপ্ত আলোকস্তম্ভ:

জীবনের অন্তিম সময়ে তিনি ছিলেন নানা শারীরিক জটিলতায় আক্রান্ত—ফুসফুস ক্যান্সারসহ নানাবিধ রোগব্যাধিতে ক্লিষ্ট। তবুও তাঁর মানসিক দৃঢ়তা ছিল অবিচল, কথাবার্তায় সদ্ব্যবহার, হৃদয়ে আশাবাদ। শেষ সময়েও তাঁর ঠোঁটে ছিল তওবার কালিমা—”লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”—যা তাঁর ঈমানের পূর্ণতা, জীবনের প্রস্তুতি আর অনন্ত জীবনের আশাবাদের প্রতীক হয়ে থেকে গেল।

এক অপূরণীয় ক্ষতি, এক অনন্ত স্মৃতি:

তিনি ছিলেন শিক্ষক, গবেষক, সংগঠক, এবং সর্বোপরি একজন আলোকিত মানুষ। তাঁর প্রস্থানে ছাত্র-শিক্ষক-সহকর্মীদের হৃদয়ে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তা কেবল অনুভব করা যায়—প্রকাশ করা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের অজস্র শিক্ষার্থী আজ এক অভিভাবককে হারিয়ে শোকাহত। সহকর্মীরা হারিয়েছেন এক বিশ্বস্ত, সুবিবেচক ও সহযোগিতাপূর্ণ সহযাত্রী। আমরা যারা তাঁকে পেয়েছি কাছ থেকে, আমাদের হৃদয়ে আজ শুধু কৃতজ্ঞতা আর অশ্রুজল।