পিঠা নষ্ট করার মন্ত্র পাঠ অতীত সংস্কৃতি
প্রাচীন ধর্মীয় বিশ্বাস ও সংস্কারের বীজ আরো সজীব ও প্রকটভাবে বিদ্যমান ছিল বাংলার প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলে। মন্ত্র ও ছড়া পাঠ করে তারা জাগতিক ও মানসিক আশা আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করার প্রয়াস করতো। তখন দেখা যায় তৎকালীন বাংলার মানুষেরা এই সংস্কৃতিতে পুরোটাই বিশ্বাস করতো।বৃষ্টি আহবানের জন্য ছড়া পাঠ হত।
” আয় বৃষ্টি ঝেপে ধান দিব মেপে” আর বৃষ্টির না হওয়ার জন্য বলা হত “লেবুর পাতায় করমচা এই মেঘ উড়ে যা” কিংবা “রোদের আকাঙ্ক্ষায় বলা হত “কলাতলায় গলা জল, ছচ্ছরায়া রোদ পড়” এমনি অনেক মন্ত্র গ্রামের মানুষের মুখে মুখে থাকতো ।ছোট ছেলেমেয়েরা মাথায় কুলা নিয়ে বাড়ি বাড়ি যায় এবং ছড়া বলে চালডাল সংগ্রহ করে।
গৃহস্থরা কুলায় পানি ঢালে আর সেই পানি দেহ বেয়ে মাটিতে পড়ে। এই হলো নকল বৃষ্টি এমন আরও সমপর্যায়ের জাদু ও মন্ত্র উচ্চারণ এর মাধ্যমে তৎক্ষণাৎ তারা দেখিয়ে দিত বৃষ্টি। তখন বৃষ্টির সঙ্গে কৃষি র নিবিড় সম্পর্ক ছিল বিশেষ করে প্রকৃতি নির্ভর কৃষি ব্যবস্থায় সময়মত এবং পরিমাণমতো বৃষ্টি না হলে কৃষকের অনেক ক্ষতি হত। কৃষকের প্রত্যাশিত এই প্রত্যাশা ছড়ার মাধ্যমে কৃষকেরা অধিক ফলনের আকাঙ্ক্ষা করতো। এখানে শক্তির প্রভাব বা মন্ত্রের মাধ্যমে কৃপা পাওয়ার চেষ্টা পরিলক্ষিত হত।
চৈত্র সংক্রান্তির দিন তুলসী তলায় হিন্দু অধ্যুষিত পরিবারের বালিকারা মাটিতে কাঠের আচড় দিয়ে আঁকত বিভিন্ন দেবতার মূর্তি আর এমন কামনা ব্যক্ত করতো যে গুলো ধর্ম গ্রন্থে না পুরাণে বর্ণিত আছে। এদের গুণাবলী ধারণ করে অথবা সৌভাগ্যের অধিকারী হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় তারা এগুলো করতো। ধর্মীয় চেতনা ছিল একেবারেই গৌণ এবং বৈষয়িক চিন্তা ছিল মুখ্য।
ভাইফোঁটা ব্রতে, ভাইকে সৌভাগ্য ও মঙ্গল কামনা করা হয়। বাপ-ভাইয়ের নিরাপদ বাণিজ্য যাত্রা আকাংখা করা হতো লক্ষ্মী ব্রতে। অধিক সন্তান পাওয়ার ব্রত, রোগ মুক্তির উদ্দেশ্যে মন্ত্র, এগুলো বাংলার লৌকিক চিন্তার বৈশিষ্ট্য ছিল।
পিঠা নষ্ট করার মন্ত্র পাঠ সংস্কৃতিঃ
মন্ত্রের মাধ্যমে যেসব সংস্কৃতি তৎকালীন সমাজে বিদ্যমান ছিল সেগুলোর একটি বৈশিষ্ট্য এখানে ব্যাখ্যা করা যায় কিছু মন্ত্র নিম্নরূপ;
” আওলা চাল বকের পাক, যেমন পিঠা তেমন থাক”
এটি হলো পিঠা নষ্ট করার মন্ত্র। পিঠা গ্রামীণ সমাজের একটি জনপ্রিয় সৌখিন খাদ্য স্থানীয় আত্মীয়-স্বজন অতিথি আপ্যায়নে পিঠা পরিবেশন করা হতো। কেউ ক্ষতি করতে চাইলে এই মন্ত্র পড়ে পিঠা নষ্ট করতে পারতো। তৈরি খাবারে নজর দিলে বদহজম হয় এ বিশ্বাস মানুষের মুখে মুখে ছিল, বিশেষত তৎকালীন গ্রামের মানুষের।
“থুথুরি মাছের ঝুড়ি
যেথায় মাছের ঘর
আমার বড়সি গিয়া পড়”
এটি মাছ শিকারের মন্ত্র বা বড়শি তে কেঁচো বা আটা জড়িয়ে এই মন্ত্র পড়ে ফেললে মাছ ধরা পড়ে এটাই বিশ্বাস। কারো শরীরে ফোড়া হলে মন্ত্র পড়া হয় আর যাতে দীর্ঘকাল ধরে স্থায়ী হয় সেটা কু-কামনা করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ জ্বর জারি হলে রোগীকে পানি পড়া খাওয়ানো হতো।
যদিও এই পানি পড়া খাওয়ার মন্ত্র এখনও বিভিন্ন প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলে প্রচলিত আছে। পীর মোল্লা মন্ত্র পড়ে পানিতে ফু দিয়ে আর বলতো
“কাল ফিরানি কাল ফিরানি
জমজমের ঠাণ্ডা পানি
এবার তুই ফিরে যা”
এগুলো সাধারণ জ্বর বা সর্দি হলে এই মন্ত্র পড়ে রোগীকে পানি পড়া খাওয়ান হতো যাতে সে শীঘ্রই সুস্থ হয়ে ওঠে। ফসলের উপর কুদৃষ্টি না পড়ে এজন্য কৃষক খেতের চারপাশে পানি ছিটিয়ে দেয় আর খেত বন্ধনের মন্ত্র পড়ে
এভাবে ফসলের উপর মানুষের কুদৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য উক্ত মন্ত্র তাদের ক্ষেতে গিয়ে উচ্চারণ করে আসতো এবং বিশ্বাস করত পরিপূর্ণভাবে ফসলে ভরিয়ে দেবে বিধাতা।
শুধু মাঠ নয়, গৃহস্থের বাড়িতে চোরের উৎপাত থেকে ঘরের সম্পদ রক্ষা করার জন্য মন্ত্র মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত ছিল। চোরের উপদ্রব থেকে রক্ষা করার জন্য চোর বন্দি মন্ত্র আছে।
তাছাড়া পিঠা নষ্ট করার মন্ত্র আছে, যেমন অগ্নি বন্ধন মন্ত্র, সর্প বন্ধন মন্ত্র, হাতি বন্ধন মন্ত্র, বন্যা প্রতিরোধ, গৃহ বন্ধন মন্ত্র, সাপে দংশিলে মন্ত্র, বাঘে কামড় দিলে ঘা ছাড়ানো মন্ত্র, ভুতে ধরলে ভুত ঝাড়া মন্ত্র এমনি আরো কত মন্ত্র। কারো ক্ষতি করার জন্য বান মারা মন্ত্র, নারী পুরুষ পরস্পরকে বশ করার জন্য বশীকরণ মন্ত্র, যেগুলো এখনও বাংলার প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলে পশচাদস্পদ সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্যমান আছে।
যদিও এগুলো বাংলার একটা অতীত সংস্কৃতি। বিশ্বাস যাই হোক না কেন এগুলো বাংলার একটা ঐতিহ্য। বর্তমান পৃথিবীর বিজ্ঞানের আশীর্বাদে এগুলো যে এখন শুধুই একটা ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে সৃষ্ট কিছু লৌকিক আচার আচরণ ছাড়া আর কিছুই নয় তা প্রমাণিত। এই মন্ত্র গুলো আদৌ কোনো কাজ হত বলে বর্তমান আধুনিক সমাজ বিশ্বাস করে না
More Stories
জাপানে সকালের ব্যস্ততা Life Cost in Japan
জাপানে প্রবাসীদের জীবনের গল্প
জাপানিজরা শত বছর বাঁচে