Colorgeo.com

Disaster and Earth Science

Spread the love

মহারাজ বিক্রমাদিত্য
কবি মাতৃগুপ্তের অজানা কাহিনী 

 

হাজারো সভ্যতা ও সংস্কৃতির দেশ ভারত। শত শত মনীষী এবং রাজা-বাদশাদের পদচারণায় মুখরিত হয়েছে ভারত ।তাইতো বাংলায় একটি কথা আছে, “ যা নেই ভারতে তা নেই পৃথিবীতে”। ইতালির পরেই পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে ভারতে। শত শত রাজা-মহারাজা, বাদশারা ভারত শাসন করেছে।আফগান থেকে তুর্কি, তুর্কি থেকে পাল, পাল থেকে মঙ্গল সবারই পদচারণায় মুখরিত ছিল ভারতের মাটি।আজ আমরা ভারতের দুজন বিখ্যাত ব্যক্তির অজানা এক গল্প জানব।

প্রাচীন ভারতের বিখ্যাত রাজা ছিলেন বিক্রমাদিত্য (Vikramaditya)

বর্তমান যুগে  বিক্রমাদিত্য নামে বেশ ক’জন রাজার কথা  জানা যায় ।তবে আমাদের ইতিহাস গড়ে উঠেছে যে রাজাকে নিয়ে তিনি হচ্ছেন গুপ্ত বংশের রাজা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য ।

 

 মহারাজা ধীরাজ বিক্রমাদিত্য ৩৭৬ থেকে ৪১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি রাজত্ব করেন । শুধু বীর রাজা হিসেবে নয় একজন দানশীল মানুষ বলে ও তার নামডাক বেশ   ছিল। বিক্রমাদিত্যের দানশীলতা নিয়ে মজার এক গল্প আছে। বিক্রমাদিত্য নিজে একজন সুপন্ডিত ছিলেন এবং জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন । বিদ্বান এবং গুণী  ব্যাক্তিদের খুব সম্মান দেখাতেন তিনি । বিভিন্ন দেশ-বিদেশ থেকে আসা গুণী পণ্ডিতদের জায়গা ছিল তার দরবারে ।পণ্ডিতদের প্রচুর ধন সম্পত্তি দান করতেন তিনি । একবার মহারাজ বিক্রমাদিত্য তার অন্যতম রাজধানী উজ্জয়িনীতে অবস্থান করেছিলেন  ।একদিন তার রাজসভায় এলেন একজন দরিদ্র কবি । তার নাম  ছিল মাতৃগুপ্ত । এই দরিদ্র কবি মহারাজের দানশীলতার কথা শুনেই তার রাজদরবারে এসেছিলেন ।তি

নি এও জানতেন যে, পন্ডিত ও ব্রাহ্মণদের নিবেদন করতে হত না। বিক্রমাদিত্য তাদের সম্মান দেখিয়ে নিজে থেকেই দুই হাতে দান করতেন ।মাতৃগুপ্ত তাই রাজ দরবারে এসে নিজে থেকে কোন প্রার্থনা করলেন না । আসলে বিক্রমাদিত্যের যে সুনাম লোকের মুখে মুখে তা তিনি পরীক্ষা করতে চাইলেন । মাতৃগুপ্তকে দেখে এবং দু’একটি কথা বলে মহারাজ বুঝলেন যে, তিনি একজন গুণী কবি । তাছাড়া কবি মাতৃগুপ্ত আত্মমর্যাদার ব্যাপারেও খুব সজাগ  ।তাকে উপযুক্ত সম্মান দেওয়া রাজকর্তব্য ।কিন্তু বিক্রমাদিত্যেরও খেয়াল চাপল  কবিকে পরীক্ষা করে দেখার । তাই তিনি কবিকে কোন অর্থ সাহায্যের কথা বললেন না । শুধু রাজপুরীর ভিতরে কবি মাতৃগুপ্তকে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন ।

রাজপুরীতে মাতৃগুপ্তের থাকার ব্যবস্থা হলেও টাকাকড়ির অভাবে খুব কষ্টে তার দিন কাটতে লাগল । তিনি সব সময় চেষ্টা করতে লাগলেন রাজার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য । রাজদরবারের সভাসদগণ রাজার গোপন ইচ্ছার কথা জানতেন না ।তারা দেখতেন কবি মাতৃগুপ্তের দীনহীন অবস্থা । কোনো সম্মানই যেন তাকে দেওয়া হচ্ছে না ।মাতৃগুপ্তকে নিয়ে তারা দরবারে নানা রসিকতা করতেন ।কিন্তু এসব কোন কিছুতেই কবি বিচলিত হতেন না ।তিনি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে থাকেন। এভাবে ধীরে ধীরে ১ বছর কেটে যায়।একদিন মহারাজ বিক্রমাদিত্য রাজপুরীর বাগানে হাটতেছিলেন। দূর থেকে তিনি মাতৃগুপ্তকে দেখলেন। অর্থকষ্টে তার বোধহয় ঠিকমতো খাবারও জোটে না। পোশাকের দশাও ভালো নয়,খুব মায়া হল  রাজার।

ভাবলেন খুব অন্যায় হয়েছে  তার প্রতি যত্ন না নেওয়ায়।দরিদ্র কবি মাতৃ গুপ্তের জন্য কিছু করা উচিত। কিন্তু কি করা যায় ? কি করলে কবিকে উপযুক্ত সম্মান দেওয়া যাবে ?তা ভেবে পেলেন না  রাজা।আরো কিছু দিন কেটে গেল। প্রচন্ড শীত পড়েছে এবার উজ্জয়িনতে ।

একদিনের কথা। মাঝরাত তখন। কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকছে রাজার ঘরে। ঘুম ভেঙ্গে গেল বিক্রমাদিত্যের । বাতাসে কোন কোন প্রদীপ নিভে গেছে।আলো জ্বেলে দেওয়ার জন্য তিনি প্রহরীদের ডাকলেন। কিন্তু প্রহরীরা তখন গরম কম্বল মুড়ি দিয়ে গভীর ঘুমে  নিমগ্ন ।রাজপুরীর একপ্রান্তে নিজঘরে তখন শুধু জেগে ছিলেন কবি মাতৃগুপ্ত। রাজার ডাক তার কানে পৌঁছালো । কবি  ধীর পায়ে  রাজার কাছে এলেন। রাজার আদেশে কবি প্রদীপগুলো জ্বালিয়ে দিলেন। মহারাজ বিক্রমাদিত্য গভীরভাবে লক্ষ্য করলেন মাতৃগুপ্তকে। মলিন পোশাকে শীতে কাঁপছেন কবি।

রাজা জিজ্ঞেস করলেন রাত এখন কত ? কবির  উত্তর  আর মাত্র দেড় প্রহর বাকি আছে রাত পোহাতে। কবির এত নিঁখুত হিসাব দেখে অবাক হলেন রাজা। রাজা বললেন ,তুমি কি রাতে ঘুমাও না।সাথে সাথে মুখে মুখে একটি কবিতা বানিয়ে ফেললেন কবি। উত্তর দিলেন সেই কবিতার মধ্য দিয়ে। তাতে মহারাজ জানতে পারলেন কবির  করুন অবস্থা। কবির  নেই কোন গরম পোশাক। নেই গায়ে দেওয়ার মতো কম্বল। খাবার জোগাড় হয়নি। তাই ক্ষুধার্ত পেট ।ঘুম  তার আসবে কেমন করে! সব শুনে রাজার বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

তিনি তখন কবি কে তার ঘরে ঘরে যেতে বললেন।পর দিন দরবারে গেলেন রাজা বিক্রমাদিত । কবি বিক্রমাদিত্যের দূত খবর এলো যে, তার রাজ্যের অংশ কাশ্মীরের রাজা মারা গেছেন।সিংহাসন নিয়ে চলছে নানা রকম  অরাজকতা । কাশ্মীরের জনগণরা আবেদন পাঠিয়েছেন একজন উপযুক্ত রাজা কাশ্মীরের সিংহাসনে বসানোর জন্য। মহারাজ কাশ্মীরের পত্রবাহক কে বলে দিলেন আমি রাজা নির্বাচন করে পত্র পাঠাচ্ছি শিগগির ।একজন দূত সেই পত্র নিয়ে কাশ্মীর পৌঁছাল। তাকে সম্মানের সাথে গ্রহণ করার জন্য মন্ত্রীকে বলবে।

কাশ্মীরের পত্রবাহক ফিরে গেল। গতরাতে রাজার ঘর থেকে অনেক কষ্ট নিয়ে ফিরেছেন কবি মাতৃগুপ্ত ।মহারাজ এর প্রতি দারুন অভিমানও হয়েছে তার। এত দানশীল বলে যে, মহারাজের সুনাম, পণ্ডিতদের সম্মান করেন বলে তার চারদিকে এত খ্যাতি । সেই মহারাজ কিনা তার এত দুঃখের কথা শুনেও কোন ব্যবস্থা নিলেন না।ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল কবির  । সিদ্ধান্ত নিলেন আজকেই চলে যাবেন এদেশ থেকে। এসব ভাবছেন কবি মাতৃগুপ্ত।এমন সময়ে রাজদরবারের প্রহরী এল ।জানালো মহারাজ ডেকেছেন রাজদরবারে  । 

 

পরের দিন মাতৃগুপ্ত ধীর পায়ে এসে উপস্থিত হলেন মহারাজের সামনে। রাজার নির্দেশে মন্ত্রী তখন একটি পত্র তুলে দিলেন কবির হাতে। রাজা বিনয়ের সাথেই বললো চিঠিটি কাশ্মীরে তিনি যেন পৌছে দেন। কাশ্মীরে পৌছেই প্রধানমন্ত্রীর হাতে দিতে হবে চিঠিটি ।সাথে সাথে সাবধান করে দিলেন পথে যাতে কেউ এ চিঠি না পরে ।কবি মাতৃগুপ্তের মনটা ভেঙ্গে গেছে।মহারাজ একি খেলা খেলছেন তার সাথে। কবিকে সম্মান দেওয়ার বদলে শেষ পর্যন্ত সামান্য পত্রবাহকের চাকরি দিলেন। কবি  কষ্ট পেলেও মুখ ফুটে কিছুই  বললেন না। রাজ নির্দেশ অমান্য করার সাহসও নেই তার।পত্র হাতে বিদায় নিলেন কবি মাতৃগুপ্ত।

 

 অনেক পথ মাড়িয়ে ক্লান্ত দেহে শেষ পর্যন্ত মাতৃগুপ্ত কাশ্মীর রাজ্যের সীমানায় এসে পৌঁছলেন ।প্রথম সীমান্ত দিয়ে ঢুকতেই টের পেলেন তার আগমনের জন্য অপেক্ষা করছেন লোকজন ।কবি মাতৃগুপ্তকে সম্মানের সঙ্গে ভিতরে নেওয়া হল। প্রধানমন্ত্রীর হাতে তিনি তুলে দিলেন মহারাজের  দেয়া চিঠি । কাশ্মীরের  রাজার বাড়িতে  নিয়ে আসা হল কবিকে ।মাতৃগুপ্ত অবাক হলেন সবাই কেমন যেন চঞ্চল হয়ে উঠেছে।অনেক সম্মানে কবিকে মূল্যবান আসনে বসানো হল।একসময় অবাক হওয়ার পালা শেষ হল তার ।

মন্ত্রী সভাসদগণ অভিবাদন জানালেন কবিকে ।জানানো হল মহারাজ বিক্রমাদিত্য কবি মাতৃগুপ্তকেই কাশ্মীরের রাজা মনোনীত করেছেন।নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে মন চাইছে না মাতৃগুপ্তের।মহারাজের প্রতি শ্রদ্ধায় তার মাথা নত হয়ে আসে। এদিকে সভাসদ পাত্রমিত্ররা কাজে লেগে যান ।সুগন্ধি গোলাপজলে গোসল করানো হয় মাতৃগুপ্তকে।বহু মূল্যবান রাজপোশাক পরানো হয় ।মাথায় দেওয়া হয় মণিমাণিক্যখচিত মুকুট ।মহা আড়ম্বরে রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কাশ্মীরের সিংহাসনে বসানো হয় কবি মাতগুপ্তকে। কাশ্মীরের রাজা হয়ে মাতৃগুপ্ত মহারাজ বিক্রমাদিত্যকে অনুসরণ করার চেষ্টা করতেন।পন্ডিত ব্যক্তিদের দানধ্যান করতেন অকাতরে। কিন্তু বেশিদিন সিংহাসনে থাকতে পারেন নি তিনি।

রাজা হিসেবে তাঁর শাসনকাল ছিল পাঁচ বছরের কিছু কম। এ সময় হঠাৎ সংবাদ এল মহারাজ বিক্রমাদিত্য মৃত্যুবরণ করে। মহারাজ বিক্রমাদিত্য মৃত্যুর কথা শুনে তিনি শোকে ভেঙ্গে পড়েন। কবি মাতৃগুপ্ত সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি কাশীবাসী হয় ধর্মের সেবায় নিজেকে নিবেদিত করবেন।কবি মাতৃগুপ্ত এবং মহারাজাধিরাজ বিক্রমাদিত্যের গল্প ইতিহাসে সত্যিই এক বিরল ঘটনা।