১৯৭০ ভোলা ঘূর্ণিঝড়
ঘূর্ণিঝড় হলো প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মের মধ্যে অস্বাভাবিক ও ব্যতিক্রম ঘটনা।সাধারণ ভাবেই গ্রীষ্মকালে উত্তপ্ত বায়ুর কারণে নিম্নচাপের ফলে বায়ুর ঘাটতি পড়ে আর তা পূরণের জন্য অন্য এলাকার শীতল বায়ু সে এলাকা দখল করে যার ফলে একটা বায়ুর ঘূর্ণি তৈরী হয়,আর এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াই ঝড়, কিন্তু যখন এটি অস্বাভাবিক রূপ নেয় তখন তা হয়ে ওঠে ঘূর্ণিঝড়।
এটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া,বিজ্ঞানীদের গবেষণামতে,পৃথিবীতে বছরে প্রায় ৮০ টি ঘূর্ণিঝড় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে যা তাপের সমতা রক্ষা করে। সমুদ্রপৃষ্ঠে তৈরী হওয়া যেকোনো ঘূর্ণিঝড়কেই সাইক্লোন বলা হয়ে থাকে।সাইক্লোন শব্দটি মূলত এসেছে গ্রিক শব্দ কাইক্লস (Kyklos) থেকে যার অর্থ বৃত্ত,কিন্তু এটি পরিবর্তিত হয়ে কাইক্লমা (Kykloma) হয়েছে অর্থাৎ আবর্তন করা। সেখান থেকে বাংলায় এটাকে সাইক্লোন ডাকা হয়।
ঘূর্ণিঝড়কে আবার অঞ্চল ভেদে ৩ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
১.ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সৃষ্ট -সাইক্লোন
ভারত মহাসাগরে সৃষ্ট সাইক্লোন সাধারণত বাংলাদেশ,ভারত,পাকিস্তান, শ্রীলংকা, মায়ানমার,থাইল্যান্ড এর উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে।
২.আটলান্টিক মহাসাগরীয় অঞ্চলে সৃষ্ট-হারিকেন।
আটলান্টিক মহাসাগরে সৃষ্ট সাইক্লোন আমেরিকার আশেপাশের অঞ্চলে আছড়ে পড়ে।
৩.প্রশান্ত মহাসাগরে সৃষ্ট সাইক্লোন চীনের এলাকাজুড়ে বিস্তার লাভ করে।
বাংলাদেশ ও ভারতে ঘূর্ণিঝড়কে বাতাসের তীব্রতা ধ্বংসক্ষমতা অনুযায়ী ৪টি ক্যাটাগরি তে ভাগ করেছে।
১.ট্রপিক্যাল সাইক্লোন বা ঘূর্ণিঝড় (গতিবেগ ৬২-৮৮কি.মি.)
২.সিভিয়ার সাইক্লনিক স্ট্রর্ম তীব্র ঘূর্ণিঝড় ( গতিবেগ ৮৯-১১৭কি.মি.)
৩.ভেরি সিভিয়ার সাইক্লনিক স্ট্রর্ম বা হারিকেন ( গতিবেগ ১১৮-২১৯কি.মি.)
৪.সুপার সাইক্লোন টাইফুন ( গতিবেগ ২২০কি.মি. <)
যখন বাতাসের গতিবেগ ৬২ কি.মি. এর নিচে থাকে তখন একে নিম্নচাপ বা ট্রপিক্যাল ডিপ্রেশন বলা হয়ে থাকে।
ঘূর্ণিঝড় এর কারণ
ঝড়ের সময় বাতাস মূলত একটা কেন্দ্র তৈরী করে প্রবল বেগে আবর্তিত হয়।ঘূর্ণিঝড় গুলো আমরা গ্রীষ্মকালেই হতে দেখি বেশি।এর কারণ এ সময় নিরক্ষীয় অঞ্চলে কোনো এলাকার বায়ু অত্যন্ত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে,আর বায়ু সেসময় উষ্ণ ও আর্দ্র থাকে,ফলে বায়ু ভূ পৃষ্ঠের উপরের দিকে উঠে যেতে থাকে।সেই স্থানে বায়ুশূন্যতার সৃষ্টি হয়। বায়ুর এই শূন্যস্থান পূরণের জন্য মেরু অঞ্চল থেকে শীতল বায়ু উত্তর গোলার্ধে দক্ষিণে নিরক্ষরেখার দিকে আর দক্ষিণ গোলার্ধে উত্তর দিকে প্রাবাহিত হয়।
কিন্তু পৃথিবীর ঘূর্ণনের ফলে সৃষ্ট কোরিওলিস শক্তির প্রভাবে বায়ু সোজা পথে না গিয়ে উত্তর গোলার্ধে ডান দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে বাম দিকে বেঁকে যায়।এ কারণে বায়ু উত্তর গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার দিকে (anti clockwise) এবং দক্ষিণ গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে (Clockwise) ঘুরতে থাকে। নিরক্ষরেখার উপর এর প্রভাব শুন্য ডিগ্রী থাকায়, আবহাওয়া ঘূর্ণিঝড়ের অনুকূলে থাকলে ঝড় হয় না।কিন্তু যখন এটি (১০-৩০) ডিগ্রী এর ভেতর থাকে তখন ঘূর্ণিঝড় হয়।
পৃথিবীর ইতিহাসে ঘটে যাওয়া ভয়ংকর ১৯৭০ ভোলা ঘূর্ণিঝড়
পৃথিবীর ইতিহাসে ঘটে যাওয়া ভয়ংকর কিছু প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর মধ্যে এখনও স্মরণীয় হয়ে আছে যে ঘূর্ণিঝড় টি তা হলো সাইক্লোন “ভোলা”,যার ভয়াবহতার কথা শুনে এখনও মানুষ শিউরে ওঠে,এটিকে ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় ও বলা হয়ে থাকে। সর্বকালের সবচেয়ে বিধ্বংসী আর মারণাত্মক ঝড় এটি।জাতিসংঘের হিসাবে সবচেয়ে ভয়ংকর প্রলয় ছিল এই ১৯৭০ ভোলা ঘূর্ণিঝড়। ১৯৭০ সালের ৮ই নভেম্বর এর উৎপত্তি হয় বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রপৃষ্ঠে।
এখান থেকে ক্রমশ শক্তিশালী হতে হতে উত্তর দিকে আগাতে থাকে, সমুদ্রের উষ্ণ বায়ুর কারণে জলরাশি স্ফীত হয়ে, এই ১৯৭০ ভোলা ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে (পূর্ব পাকিস্তান) বর্তমান বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলীয় দ্বীপ ও সেসব অঞ্চলে।তারপর তা গতিবেগ বাড়তে বাড়তে আরো শক্তি সঞ্চয় করে শক্তিশালী হয়ে উঠে জলোচ্ছ্বাসে রূপ নেয়,যার উচ্চতা ছিল ১০-৩৩ফুট। ঘন্টায় সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ৩ মিনিট স্থায়ী ১৮৫ কি.মি.(১১৫ মাইল) -১ মিনিট স্থায়ী ২০৫ কি.মি.(১৩০ মাইল)।সর্বনিম্ন চাপ ৯৬৬ মিলিবার পারদস্তম্ভে উচ্চতা ২৮.৫৩ ইঞ্চি।সিম্পসন স্কেল অনুসারে এটি “ক্যাটাগরি ৩” মাত্রার ঘুর্ণিঝড়।
এই ঝড়ের তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় ভারত ও বাংলাদেশের (পূর্ব পাকিস্তান) এর অঞ্চলসমূহ।প্রচুর বৃষ্টিপাত এর ফলে উপকূলীয় এলাকার অধিকাংশই বিলীন হয়ে যায় নদী গর্ভে,প্লাবিত হয় চারদিক।ঘর-বাড়ি, গ্রাম,গবাদিপশু, শস্যাদি সহ পানিতে চলে যায়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় লক্ষাধিক মানুষ। আরো প্রাণ হারায় যারা তাদের সংখ্যা ৫লক্ষেরও বেশি। যার অধিকাংশই গাঙ্গেয় বদ্বীপে জলোচ্ছ্বাসে ডুবে মারা যায়।১০ লক্ষাধিক গবাদিপশু প্রাণ হারায়।
প্রায় ৪ লক্ষেরও বেশি বাড়িঘর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা চর তজুমদ্দিন,এ এলাকার ৭৭০০০ লোক এর প্রাণহানি ঘটে,মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৬%।আরও যেসব এলাকায় এ ঝড় তাণ্ডবলীলা চালায় তার মধ্যে আছে চট্টগ্রাম, ভোলা,মনপুরা,চরফ্যাসন, সন্দ্বীপ,বরগুনা,খেপুপাড়া,বোরহানুদ্দিন,পটুয়াখালী,দক্ষিণ মাঈজদি,হারিয়াঘাটা।
এসব এলাকার মানুষ আজও ডুকরে ওঠে সেই ঝড়ের তাণ্ডবে হারানো স্বজনের আহাজারিতে।
More Stories
Russell Viper নিধন কেন সমাধান নয়?
চন্দ্রবোড়া সাপ কামড়ালে কি করা উচিত
সাপ্তাহিক চাকরির খবর ২০২৪