বাঁধা গরু ছাড়া পেলে যা হয় (জীবনের গল্প)
তখন আমি বারো ক্লাসে (জনৈক)। সবে বাঁধা গরু ছাড়া পেতে শুরু করেছি। পড়ার চাপের পাশাপাশি বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে হঠাৎ বড় হয়ে যাবার একটা অদম্য ইচ্ছা। বাবা কোনদিন মারতেন না, খুব জোর গলায় বকতেন এমনও মনে পড়ে না। তবে তাঁর শাসনে ছিল বুদ্ধিমত্তার ছাপ। তাঁকে ভয় করতাম। বাবা সিগারেট খেতেন।
সিগারেটের গন্ধটা আমার খুব ভাল লাগত। বাবার সিগারেটে টান দেওয়া, রিং করে ধোঁয়া ছাড়া, ঠোঁটের কোণে সিগারেট নিয়ে কাগজ পড়া এই সব মিলে বাবাকে খুব ম্যানলি লাগত। তাই কলেজে বন্ধুরা যখন সিগারেট অফার করল, তখন নিজের শরীরেও একটা পৌরুষ ফুটিয়ে তোলার স্বপ্নে, না বলতে ইচ্ছে হয়নি ।
একটা দুটো করে সিগারেটে টান দিতে শুরু করলাম। আর শুরু করলাম রাত্রে বাবা ঘুমিয়ে পড়লে, বাবার সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট চুরি করতে। একটা, দুটো করতে করতে মাঝে মাঝে তিন চারটেও হয়ে যাচ্ছিল।
গভীর রাত্রে পাড়া নিশুতি হয়ে গেলে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই সিগারেটে সুখটান দেবার মধ্যে কি যে একটা মাদকতা ছিল, ছিল একটা টানটান উত্তেজনা। সেদিন ও রাত্রে বাবা ঘুমিয়ে পড়লে তার ঘরে পা টিপে টিপে ঢুকে সিগারেটের প্যাকেট টা আস্তে করে নিয়ে নিজের ঘরে এলাম। প্যাকেট টা খুললাম রোজকার অভ্যাসমত।
কিন্তু সিগারেট বার করতে গিয়ে একটা কাগজ দেখলাম ভাঁজ করে গোঁজা আছে। বার করলাম। দেখলাম তাতে লেখা আছে
১) সিগারেট খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক।।
২) তবুও যদি একান্ত খেতেই হয়, তা নিজের উপার্জনেই খাওয়া উচিৎ।
৩) প্যাকেটে সাত টা সিগারেট আছে। কাগজ টা আবার ভাঁজ করে যেমন ছিল সেভাবেই প্যাকেটে রেখে দিলাম। সিগারেট আর বার করা হয়নি।
লেখা শব্দগুলো শব্দভেদী বাণের মত বুকে গিয়ে এমনভাবে বিঁধেছিল যে সারা জীবনের মত বেকার অবস্থায় অন্যের পয়সায় সিগারেটে সুখটান দেবার সুখকে জলাঞ্জলি দিয়েছিলাম। এর প্রায় ৪০ বছর পর, আমি এখন স্কুলে পড়া এক ছেলের বাবা। আমি নিজের পয়সায় করা সিগারেটের নেশাটা ছাড়ব ছাড়ব করেও ছেড়ে উঠতে পারছিনা।
তবে ছেলে বড় হয়েছে বলে বাড়িতে কম খাই। আমার জামার বুকপকেটে বা অফিস ব্যাগে সিগারেটের প্যাকেট লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করি। একদিন লক্ষ্য করলাম, আমার প্যাকেট থেকে সিগারেট চুরি হচ্ছে।
তবে এ চোর নয়, ডাকাত, একটা রেখে সব সিগারেট গুলোই হাওয়া করে দিচ্ছে। কিন্তু কিছু বলতেও পারছিনা। কি বলব.? ছেলে বড় হয়েছে। অনেক ভেবে আমার বাবা’র সেই পদ্ধতির প্রয়োগ করলাম। একটা কাগজে বাবার দেওয়া তিনটে পয়েন্টেই একটু এদিক ওদিক করে লিখে কাগজ টা ভাঁজ করে ঢুকিয়ে রাখলাম।
লিখলাম,
১) টিভি সিনেমায় বিজ্ঞাপনে হরদম দেখাচ্ছে সিগারেট খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক, সেটা কি চোখে পড়েনা.?
২) তবুও বলি যদি একান্ত খেতেই হয়, তা নিজের উপার্জনেই খাওয়া উচিৎ।
৩) সব সিগারেট নিয়ে একটা রাখার কি মানে বুঝলাম না। প্যাকেটে পাঁচটা সিগারেট আছে। পরেরদিন একটু আগেই ঘুম ভাঙল, ছুটে গিয়ে প্যাকেট টা খুললাম, আমার ওষুধে কতটা কাজ হয়েছে দেখার জন্য।
দেখলাম সব কটা সিগারেট অক্ষত আছে, সাথে আছে ভাঁজ করা একটা কাগজ…
১) সিগারেট খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক তা তো সবার চোখেই পড়ে। তবু জেনেও যে সেই বিষ নিয়মিত খায়, তার কতটা উচিৎ অন্য কাউকে শেখানো.?
২) নিজের পয়সা বলে কি বিষ কিনে খাওয়া যায়.? আর সেই আত্মহত্যার সাথে যদি অন্যের জীবনের ভালমন্দ জড়িত থাকে, তার কি সেটা করা উচিৎ.? তোমার কিছু হলে আমাদের কি হবে.?
৩) আমি সিগারেট খাইনা। আমি সিগারেট গুলো নষ্ট করে ফেলতাম। একটা ছাড় দিতাম রোজ ভোরবেলায় এক বিশেষ কাজে লাগে বলে। আর তা করতাম আমার বাবার ঐটুকু ক্ষতি অন্তত কমানোর জন্য।
আজ সব গুলোই ফেরত দিলাম, তাঁর শুভবুদ্ধির অপেক্ষায়…
বাঁধা গরু ছাড়া পেলে যা হয়
Read More:
কবিতা ডাক্তার আখতার
Artwork; এক নারীর গল্প
More Stories
প্রফেসর মদন মোহন দে যে 4 টি কারনে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ছিলেন
বেগম রোকেয়া স্মৃতিবিজড়িত ভাংনী জমিদার
কে এই বিষ্ণুপ্রিয়া রূপে গুনে অতুলনীয়া