মোঃ নাইম আহমেদ
————————
সেদিন ম্যাচ থেকে বাড়ি ফিরছিলাম, পরিক্ষা শেষ বলে। অনেক দিন হলো বাড়ি যাই না। তাই মনে অনেক আনন্দ হচ্ছিল। শেরপুর হতে সোনামুখী আসলাম CNG তে। আর সোনামুখী থেকে বড়ির উদ্দেশ্যে উঠলাম বাসে। আর সেই বাসের মধ্যেই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ও শ্রেষ্ঠ শিক্ষা পেলাম।
আমি যখন ক্লাস নাইন-টেনে তারাকান্দি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়তাম, তখন বাসে করে আসা যাওয়ার সময় তাকে কলেজে যেতে দেখতাম। তিনি আর কেউ নন, RIM ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক। আমাদের স্কুলের পাসেই ছিল সেই কলেজ।
যাই হোক, বাসে করে বাড়ি তে আসার পথে প্রথমে কলেজ, তারপর স্কুল। কলেজের কাছে বাস থামতেই তিনি বাসে উঠলেন। বাসে যথেষ্ট পরিমান ভির ছিলোনা। আমি বাসের পেছনের আগের ছিটে বসা ছিলাম। তিনি এসে ঠিক আমার সিটের বাম পার্শ্বের সিটে বসলেন। আমি বসে বসে ভাবছিলাম কখন যে বাড়িতে গিয়ে পৌঁছাব। বাস যখন সিমান্ত বাজার এসে পৌঁছাল তখন কয়েকটা মহিলা উঠলো, কিন্তু তাদের বসার সিট হলো না। ঠিক সেই মহূর্তে বাসের কনট্রাকটর একজন হিন্দু মহিলা ও তার কিশোরী মেয়ে কে বাসের পেছনের অংশে আসতে বললো। হটাৎ সামনে তকিয়ে দেখি অনেক লোক উঠে গেছে, যেন দাঁড়ানোর জায়গা নেই! তাদের মধ্যে একজন প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। তিনি শুরু থেকেই হাকা হাকি করছিলেন যে, বসার সিট না হলে তিনি নেমে যাবেন। কনট্রাকটর সাহেব তাকে কোন রকমের পেছনে পাঠিয়ে, সেই প্রভাষক স্যারের কাছে বসিয়ে দিল। কিন্তু হিন্দু মহিলা ও তার মেয়েকে দড়িয়ে থাকতে দেখে প্রভাষক স্যার সহ্য করতে পারলো না। তিনি সিট ছেড়ে দিলেন এবং তিনি দাড়িয়ে হিন্দু মহিলাকে বসতে দিলেন। কিন্তু কন্ট্রাক্টর বলতেও পারছেনা, সইতেও পাড়ছে না যে প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক কে উঠে কিশোরী মেয়ে টাকে বসতে দিতে। এদিকে বাস ভর্তি লোকের চাপাচাপিতে কিশোরী মেয়েটি পড়েছে বিপাকে। এমতাবস্থায় আমার বাড়ি যাবার আনন্দ মূর্ছা গেল। আমি সিটে বসে লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম। সিটে বসে আরামে বাড়ি যাবার বাসনা ত্যাগ করলাম। আমি প্রভাষক স্যারকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে হতবাক হয়ে গেলাম। আমি আর এক মূহুর্ত বসে থেকতে পারলাম না। কোন এক কারণে হয়তো পরিচিত কার সাথে কতা বলার জন্য প্রাইমারী স্কুলের স্যারটি উঠে পেছনে গেলে অমনি কিশোরী মেয়েটি পুরুষ মানুষের চাপাচাপি থেকে বাঁচতে মায়ের কাছে দ্রুত বসে পরলো। তখন সেই প্রাইমারী স্কুলের স্যারটি এসেই সিট না পেয়ে আবার হাকা হাকি শুরু করে দিল। আমি সেই মহূর্তে প্রভাষক স্যারকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে আমি আর নির্বোধের মত বসে থাকতে পারলাম ন।
মনে হলো আর এক মূহুর্ত বসে থাকলে আমার জীবনের অনেক বড় একটি জিনিস হারিয়ে যাবে।তখন আমি আমার সিটটা ছেড়ে দিয়ে প্রভাষক স্যারকে বসতে দিলাম। কিন্তু স্যার আমাকে না উঠার জন্য চাপাচাপি করতে লাগলো। আর বলল, না না, উঠার দড়কার নাই, আমি দাড়িয়ে যেতে পারবো। কিন্তু আমার বিবেক আমাকে ধমক দিয়ে বলল, হে বোকা ছেলে! যে মানুষ একজন প্রভাষক হয়ে একটা হিন্দু জেলে বউকে বসতে দিলো, আর নিজে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, তাকে তুই সম্মান করতে শিখলি নাহ? তখন আমি তালগোল হারিয়ে বিদ্যুৎ গতিতে উঠে আমার ব্যাগ হাতে নিয়ে প্রভাষক স্যারকে আমার সিটে বসার অনুরোধ করলাম। তখন স্যার নিজে না বসে প্রাইমারী স্কুলের সেই স্যারকে জোর করে বসালেন। আমি তখন স্যারের ডান পাসে স্টান্ড ধরে দাড়িয়ে রইলাম। তখন স্যার আমার মাথায় হাত রেখে দোয়া করলেন, বেঁচে থাক বাবা। তার পর স্যারের সাথে অপূর্ব সব কথা বার্তা বলতে বলতে কখন যে ভেওয়ামারা এসে পৌঁছে গেলাম, বুঝতেই পারলাম না। তখন স্যার কে আমার বাড়ি যাবার জন্য অনুরোধ জানালাম। স্যার খুশি হয়ে বলল, নাহ! ঠিক আছে তুমি যাও। সেদিন বাসের মধ্যে দাড়িয়ে স্যারের সাথে আমার যে অপূর্ব কথোপকথন হয়ে ছিলো তার সারমর্ম হলো এই যে,”শুধু একজন ভালো ছাত্র হওয়ার চেয়ে ভালো মানুষ হওয়াটা বেশী জরুরী। আর কিছু মানুষ তোমাকে ঠিক ততক্ষণই মূল্যায়ন করবে, যতক্ষণ তার স্বার্থ থাকবে। স্বার্থ ও শেষ, তার কাছে তোমার ভ্যালু ও শেষ”।
সেদিন স্যারের কাছে থেকে যে শিক্ষা পেলাম তা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা এবং তিনিই হলেন আদর্শ শিক্ষক।
মোঃ নাইম আহমেদ
২য় বর্ষ, ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগ,
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
More Stories
Bhola cyclone; the devasted Natural Disaster in Bangladesh in 1970
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে গুগলের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন
Is asbestos a carcinogenic