মতুয়া ধর্ম কি ? What is Matua Community
যে সমাজ শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত অজ্ঞ, অচ্ছ্যুত, অস্পৃশ্য জনগোষ্ঠী মনুসংহিতায় এদেরকে ইতর প্রাণী বলে বর্ণনা করা হয়েছে। ব্রাহ্মণদের জন্যে এদের সঙ্গে একই ছাদের নিচে অবস্থান এমনকি একই গাছের নিচে দাঁড়ানোও সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ছিল । চণ্ডাল ও শূদ্রগণ গ্রাম বা নগরে বসবাস করার যোগ্য ছিল না ।
ঠিক এই কারণেই এই বিষয়টি সহজেই অনুমেয় যে চণ্ডাল বা নমশূদ্র (অভিন্ন অর্থে) নগর বা বন্দরে বসবাস করত না; তারা রোষানল বা শ্রেণিবিদ্বেষের কারণে প্রত্যন্ত বিল, খাল, ডোবা, চরাঞ্চল বা নিভৃত অঞ্চলে প্রক্ষিপ্ত হয়ে বন-জঙ্গল কেটে বসতি গড়েছিল।
ইতিহাস প্রমাণ দেয় আজও নমশূদ্রগণ ব্যাপকহারে নগরের বাসিন্দা হয়নি । রাজার অনুমোদিত বিশেষ চিহ্নে চিহ্নিত হয়ে এরা শুধুমাত্র দিনের বেলা নগর বা গ্রামে ঢুকতে পারত । তাই ব্রাহ্মণবর্ণের কোনো ব্যক্তি যদি চণ্ডাল বা শূদ্রকে হত্যা করত, তাহলে প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ তাকে শুধুমাত্র চন্দ্রায়ব্রত করলেই হতো, আর কোনো শাস্তির বিধান তার ছিল না ।
মনুসংহিতার পরবর্তীকালে রচিত গ্রন্থ ‘পরাশর সংহিতা’-এর অনুশাসনও অনুরূপ । এই গ্রন্থে উল্লিখিত আছে যে একজন চণ্ডালকে খুন করার পর ব্রাহ্মণের এক দিবা রাত্র উপোস করে ধ্যান করলেই পাপমোচন হয় । পরাশর সংহিতার যুগে ব্রাহ্মণদের নিকট চণ্ডাল বা শূদ্রের রান্না করা ভাতও গরুর মাংস সমান অপবিত্র ।
খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম থেকে তৃতীয় শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময় রচিত বশিষ্ঠ পুরাণেও এইরূপ অস্পৃশ্যের বর্ণনা পাওয়া যায়। উক্ত পুরাণে উল্লিখিত আছে, যদি কোনো ব্ৰাহ্মণ শূদ্রের অন্ন খেয়ে মারা যায়, তাহলে পরজন্মে সে শূকররূপে জন্মগ্রহণ করবে (যদিও এটা আমি বিশ্বাস করি না)। উপর্যুক্ত সংহিতা ও পুরাণ থেকে তৎকালীন সমাজের অস্পৃশ্যতা এবং নিম্নবর্গ মানুষের প্রতি উচ্চবর্ণের নিগ্রহ, নির্যাতন, নিষ্পেষণ সহজেই অনুমান করা যায় ।
————–
শত শত বছরের নির্যাতন, নিগ্রহ সংহিতা ও পুরাণের অনুশাসন উচ্চবর্গের মানুষের দ্বারা নিম্নবর্গের বঞ্চনা, শ্রমজীবী, চাষি, কামার, কুমার অস্পৃশ্যতার যাঁতাকলে পিষ্ঠ হতে হতে তারা এরূপ অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি লাভের উপায় খুঁজছিল ।
তাই ঐ সকল নিম্নবর্গের মানুষ উচ্চবর্ণের মানুষের প্রতি দ্রোহে ধর্মীয় জীবন পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে নিজেদের মুক্তির অনুসন্ধান করছিল। তাই তারা এই বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মের আবির্ভাবের সাথে সাথে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা পূর্বক হাজার বছরের ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে এক দ্রোহের সূচনা করে, যা পরবর্তীতে মুসলিমদের আগমনেও সেই একই জীবনপথ পরিগ্রহ করে।
ঠিক একইভাবে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষে যখন ঔপনিবেশিক শাসন শুরু হয় এবং বিভিন্ন স্থানে মিশনারিজ অব চ্যারিটিজ সেবার নামে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করতে থাকে, তখনও এই নমশূদ্র বা দলিত সম্প্রদায় তথা আপামর অস্পৃশ্য জনগোষ্ঠী খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হতে থাকে, যে ধারা আজও বহমান।
এইরূপ একটি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিবেশে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যেও নিম্নবর্গের মানুষের প্রতি বর্ণবাদী ব্রাহ্মণ তথা অন্যান্য উচ্চবর্ণের হিন্দুদের উন্নাসিকতা, অবহেলা, অবজ্ঞা, ঘৃণা সমানভাবেই চলতে থাকে।
ঠিক এইরূপ একটি আর্থ-সামাজিক অবস্থার মধ্যে যখন সনাতন হিন্দুধর্মাধীন বিভিন্ন নিমবর্ণ, উপবর্ণের প্রতি উচ্চবর্ণের মানুষের অশ্রদ্ধা, অবহেলা, অবজ্ঞা, উন্নাসিকতা, ঘৃণা, বঞ্চনা, কৌলিন্যতা, ছুঁতমার্গীয় মনোভাব তুঙ্গে, ঠিক তখনই ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় এক নব বারতা নিয়ে তৎকালীন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমায় ‘মতুয়া’ ধর্মের (Matua Community) উদ্ভব। এখানে ধর্ম না বলে একটা মতবাদ বা দর্শন বলা শ্রেয়। এই দর্শনের যিনি প্রবর্তক তিনি হলেন হরিচাঁদ ঠাকুর । তাঁর ভক্তগণ তাঁকে পূর্ণব্রহ্ম শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর বলে বিশ্বাস করেন । বিশ্বাস যে কোন কিছুতেই মানুষ করতে পারে।
১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের ১১ মার্চ, বাংলা ২৯শে ফাল্গুন ১২১৮ মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথি বুধবার গোপালগঞ্জ মহকুমা অধুনা জেলার সফলাডাঙ্গা গ্রামে এক নমশূদ্র, তৎকালীন সময় চণ্ডাল বলে কথিত, পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
মতুয়া ধর্মের (Matua Community) অনুসারীদের মধ্যে নব্বই থেকে পঁচানব্বই ভাগই নমশূদ্র সম্প্রদায় যদিও দলিত সম্প্রদায় এর মধ্যে মিশে আছে; বাকি পাঁচভাগ রয়েছে বিভিন্ন নিম্ন বর্ণসম্প্রদায়, যেমন – পৌণ্ড ক্ষত্রিয় বা পোদ, কাপালী, কুমার, কামার, জেলে, ঋষি (চর্মশিল্পী) প্রভৃতি, এমনকি কিছু মুসলমান কৃষকও এই মতুয়া ধর্মের মুরিদ হয়েছেন। ভারতবর্ষীয় শ্রমজীবী মানুষদের মতুয়া মতবাদ আকৃষ্ট করেছে ।
তবে একথা অনস্বীকার্য যে তথাকথিত উচ্চবর্ণের হিন্দুগণ মতুয়াবাদের প্রতি তেমন আকৃষ্ট হননি । যাই হোক নিঃসন্দেহে বলা যায় মতুয়া ধর্ম শ্রমজীবী মানুষের সামাজিক ও ধর্মীয় অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
———–
মতুয়া লোককবি রাজেন্দ্রনাথ সরকার তাঁর একটি ধুয়াগানে উল্লেখ করেছেন নমশূদ্র সমাজ ও মতুয়াধর্ম (Matua Community) নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত ।
ধুয়া গানটির কয়েকটি ছত্র তুলে দেয়া হলো—
যত নমশূদ্র ভাব সমুদ্রে করে সন্তরণ
ইহার মূলতত্ত্বে হরিঠাকুর, ফরিদপুর,
প্রচার করিল নাম সুমধুর, হরিসংকীর্তন ॥
মতুয়া শব্দটি মূলত প্রকৃতিগতভাবে মূল শব্দ ‘মত’-এর সাথে ‘উয়া’ প্রত্যয় যোগে মতুয়া রূপটি এসেছে। মতুয়া শব্দটির অর্থ হলো কোনো বিশেষ মতাদর্শে বা ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ এমন একটি জনগোষ্ঠী। আদি অস্ট্রেলীয় মাউরী জনেগোষ্ঠীর ভাষায় মতুয়া শব্দটির অর্থ হলো বন্ধুসংঘ ।
প্রশান্ত মহাসাগরীয় পলিনেশীয় দ্বীপ রাষ্ট্রের প্রাচীন চামেরু সমাজের দুটি বর্ণের মধ্যে উচ্চবর্ণটির নাম মতুয়া, যে বর্ণের হুতু মতুয়া নামে কিংবদন্তি পলিনেশীয় রাজার পরিচয় পাওয়া যায় যিনি তাঁর গোষ্ঠীকে পূর্বাঞ্চলীয় রাপা নুই দ্বীপে সর্বপ্রথম বসতি গড়তে পরিচালিত করেন ।
নিউজিল্যান্ডের মাউরী সমাজে মতুয়াকোরী নামে এক মাউরী দেবতার পরিচয় পাওয়া যায় ।
মতুয়া ধর্ম হিন্দু লোকধর্মের একটি শাখা, যাকে Folk Religion বা Ethnic Religion বলা যায় । চাষাভূষা কায়িক শ্রমজীবী জনমানবের একটি জনপ্রিয় ধর্ম যেখানে ঐতিহ্যবাহী প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের শাস্ত্রীয় কঠোর কঠিন নিয়মের বালাই নেই । মতুয়া ধর্মের ন্যায় লোকধর্মের অস্তিত্ব পৃথিবীর সর্বত্রই রয়েছে।
এটিকে মা, মাটি, মানুষের ধর্ম বললেও অত্যুক্তি হয় না। আমরা যদি পাশ্চাত্যের ধর্ম দর্শনের ইতিহাস দেখি তাহলে দেখতে পাই পাদ্রি প্রভাবিত খ্রিস্টধর্ম, যে সকল মানুষ রয়েছে মাটির সাথে মিশে; এদেরকে রাস্টিক, প্যাগান বা হিদেন নামে অভিহিত করে ।
এই মতুয়া সংস্কৃতি (Matua Community), প্যাগান বা হিদেন সংস্কৃতি বরাবরই স্মরণাতীতকাল থেকেই প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত সুবিধাবাদী ধর্মীয়-সামাজিক রীতি-পদ্ধতির বিরোধিতাই করে থাকে।
লোকধর্মের যে বৈশিষ্ট্য যেমন অসাম্প্রদায়িক চেতনা, সহজ সরল ও সকলের জন্য পালন উপযোগী ধর্মাচার, এগুলিই মতুয়া ধৰ্ম তথা অন্যান্য লোকধর্মে বর্তমান । মতুয়া ধর্ম (Matua Community) বা মতুয়া সম্প্রদায়ের ন্যায় প্যাগান, হিদেন, এমনকি হান চাইনিজ, জাপানের শিন্টো ( কোন নির্দিষ্ট দেবতা বা ভগবান নাই প্রকৃতি তাদের ঈশ্বর), প্রাচীন আমেরিকান লোকধর্ম আফ্রিকা মহাদেশের শত শত লোকধর্ম ইত্যাদি বিশ্বব্যাপী লোকধর্মের বৈশিষ্ট্য বহন করে।
পৃথিবীর প্রথাগত প্রতিষ্ঠিত ধর্মের অনুশাসনের ন্যায় মতুয়া ধর্মেরও দ্বাদশ অনুশাসন বা আজ্ঞা রয়েছে।
————
শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর বাল্য বয়সেই আত্মদর্শনপ্রাপ্ত হন ( আমি আপনি কি আত্ম দর্শন পেতে পারি উত্তর হল হাঁ কিভাবে কোন নির্জন স্থানে গিয়ে কিছুদিন বসবাস করুন এবং মনকে কেন্দ্রীভূত করুন আমরা যাকে বলি ধ্যান) এবং পরবর্তীকালে এই আত্মদর্শনের মাধ্যমেই প্রাপ্ত দ্বাদশ অনুশাসন মানুষের মাঝে প্রচার করেন । এটি হচ্ছে মানব জাতির জন্যে বিশেষ নির্দেশনা বা শিক্ষা যা প্রতিটি মানুষকে ন্যায়, পবিত্রতা, সত্য ও আলোর পথে পরিচালনা করতে সহায়ক ।
শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর নির্দেশিত মতুয়া ধর্ম এর (Matua Community) দ্বাদশ আজ্ঞা বা অনুশাসনগুলি নিম্নরূপ
১. সদা সত্য কথা বলিবে ।
২. পরস্ত্রীকে মাতৃজ্ঞান করিবে ।
৩। প্রেমদান করো বিশ্বে যতজন প্রাণী
৪. জাতিভেদ করিও না সচিত্র চরিত্রে।
৫. ভক্তি করো মাতাপিতা একনিষ্ঠ চিত্তে।
৬। ষড়রিপু হতে থাকো সদা সাবধান ।
৭। পরধর্মে নিন্দা তুমি করো পাপ জ্ঞান ।
৮। পরিত্যাগ করো বাহ্যঅঙ্গ সাধু সাজ।
৯।বল মুখে হরিবোল হাতে করো কাজ ।
১০. প্রতিষ্ঠিত করো গৃহে শ্রী হরি মন্দির ।
১১. দৈনিক প্রার্থনা করো নোয়াইয়া শীর।
১২. শ্রী হরিতে আত্মদান করহে মানব ।
মানিলে দ্বাদশ আজ্ঞা সকলই সম্ভব।
অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর তাঁর প্রবর্তিত মতুয়া ধর্মকে প্রচার ও প্রসারকল্পে মতুয়া মহাসংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। এটি হচ্ছে একটি ধর্মসংস্কারমূলক আন্দোলন। যেটি মূলত ওড়াকান্দি থেকেই উৎপত্তি হয় । এই সংঘ প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে তিনি সত্য ভালোবাসা, সহিষ্ণুতা, লিঙ্গ সাম্যতা এবং বর্ণবৈষম্যহীন একটি সমাজ গঠনের দৃঢ় প্রত্যয়ে এগিয়ে যান।
দেশভাগের পর হাজার হাজার মতুয়াভক্ত পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি দেন এবং শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের দৌহিত্র শ্রী প্রমথরঞ্জন ঠাকুর উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার ঠাকুর নগরে মতুয়া সংঘের সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠা পূর্বক সমগ্র ভারতবর্ষে প্রচার কাজ চালাতে থাকেন । মতুয়া মহাসংঘ (Matua Community) আত্মদীক্ষাকরণ মতবাদে বিশ্বাস করেন।
তাই যে কোনো নর-নারী যার শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের দর্শনের উপর পূর্ণ বিশ্বাস আছে, তিনিই মতুয়া মহাসংঘের (matua mahasangha) অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং তারা কোনো গুরুর নিকট থেকে দীক্ষা নিতেও পারেন, আবার নাও নিতে পারেন।
তবে মতুয়াগণ হরিচাঁদ ঠাকুর পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুরকে গুরু বলে স্বীকার করেন । তাঁরা মা ভক্তি না থাকলে তাদের সকল সাধন ভজন মিথ্যা । সাধন ভজনের ক্ষেত্রে মতুয়াগণ গুরুচাঁদ ঠাকুরকে অধিক গুরুত্ব প্রদান করে থাকেন।
শতকর্ম ব্যস্ততার মধ্যেও তাঁরা হরিচাঁদ ঠাকুরের ভজনা করেন, তবে যদি হরিচাঁদের ভজনায় কখনো ছেদ পড়ে যায়, তাঁরা গুরুচাঁদ ঠাকুরের বাণীগুলি স্মরণ করেন এবং হরিচাঁদ ঠাকুর তাতে কৃপাবর্ষণ করেন । তাই মতুয়া সঙ্গীতে বলা হয়েছে—
‘কর্মসূত্রে হরি হলে বাম, গুরু রাখলে রাখতে পারে যায় না পরিণাম, গুরুগোঁসাই হইলে বাম, হরিচাঁদ রাখতে পারে না।
গুরু বলতে দুটি অর্থ হয়, গু বলিতে চিত্তগুহতম রাশিময়, রু বলিতে রবি উদয় হলে আর আঁধার থাকে না।’
গুরুচাঁদ ঠাকুর ছাড়াও অন্য গুরুকে দীক্ষাগুরু হিসেবে গ্রহণের রীতি মতুয়াদের মধ্যে প্রচলিত আছে । তবে গুরুকে গুরুতত্ত্ব জানার বিষয়টির উপর মতুয়াগণ বেশি গুরুত্বারোপ করেছেন। গুরুকে অবশ্যই গুহ্যতত্ত্ব সম্পন্ন কপটতামুক্ত হতে হবে । মতুয়াদের মতে একজন গুরু হবেন জীবনের সকল পঙ্কিলতা, মলিনতা ও সংকীর্ণতামুক্ত এবং সূর্যের আলোয় ভাস্বর ।
তারা ভণ্ড গুরুকে বর্জনপূর্বক সঠিক গুরুর সান্নিধ্য লাভ করতে চেয়েছেন। তাই গুরুকে হতে হবে যেমন সঠিক পুরুষ অর্থাৎ গুরুতত্ত্ব বিষয়ে তাঁর অগাধ জ্ঞান । সুতরাং শিষ্যকেও সঠিক গুরু বেছে নিতে হবে । এই সঠিক গুরু খুঁজে বের করার বিষয়ে চারণ কবি বিনোদ সরকারের একটি মতুয়া গানে পাওয়া যায়—
ভণ্ড গুরুর পড়লে ফেরে জীবন যাবে রসাতলে।
আবার শুরু যদি খাঁটি হয় তবে মনে বলে হরিবল হরিবল
গুরুর কৃপা গুরুর জ্ঞান
শিষ্যকে দেয় পরম ধন
গুরু তত্ত্ব না জানিলে
শিষ্যের যায় জীবন মানঃ
মতুয়াগণ (Matua Community) গুরুভক্তি করলেও তারা একান্তভাবে গুরুবাদী নয়। গুরুই যে একমাত্র ঈশ্বর প্রাপ্তির পথ দেখাতে পারেন; তারা এরূপ ধারণা পোষণ করেন না । মতুয়াদের (Matua Community) মধ্যে গুরুর নিকট থেকে দীক্ষাগ্রহণের তেমন অনিবার্যতা নেই ।
জন্মসূত্রে মতুয়ারা (Matua Community) পারিবারিকভাবে মতুয়া ধর্ম পালন করে থাকেন। তবে মতুয়াদের (Matua Community) মধ্যে নারীগুরু গ্রহণ একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। তাঁদের মধ্যে নারীগণও গুরুর আসনে সমাসীন হতে পারেন ।
মতুয়াগণ (Matua Community) জন্মান্তরবাদ ও অবতার তত্ত্বে বিশ্বাস করেন; তবে তাঁদের এই বিশ্বাসের মধ্যদিয়ে মায়াবাদী দর্শন ফুটে ওঠে । তাঁরা নারীকে আদ্যাশক্তিরূপী জগতের সকল বিশ্বাস এবং প্রতিটি জীবের মধ্যেই এই শক্তির অস্তিত্ব রয়েছে । এই শক্তি হলো মহামায়া যিনি জগতের জীবকুলকে মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ রেখেছেন ।
মতুয়াদের (Matua Community) নিকট শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর ও তদীয় সহধর্মিনী শান্তিদেবী উভয়েই সমভাবে পূজ্য । পৌরাণিক দেব-দেবী বিষ্ণু ও লক্ষ্মী যেমন হিন্দুর মানসলোকে বিরাজমান ঠিক তেমনি শ্রীহরি ও শান্তিদেবীও তাঁদের মানসলোকে বিরাজমান। মতুয়াদের নিকট শান্তিদেবী আদ্যাশক্তিরূপী আরাধ্য জননী, তিনি লক্ষ্মীস্বরূপা স্বয়ং নারায়ণের বা মহামায়ারূপী শিবের সহচরী।
তাঁরা শ্রী হরিচাঁদ ও শান্তিদেবীর যুগল বন্দনায় আত্মনিবেদিত । মতুয়াগণ নারী-পুরুষের যৌথ সাধনার ধারা প্রবর্তন করেন। তাঁদের সাধনা গার্হস্থ্য জীবনকেন্দ্রিক। মতুয়াগণ (Matua Community) কৃষিজীবনের সাথে সম্পৃক্ত।
তাই কৃষি পরিবারের দৈনন্দিন জীবনের টানাপোড়েন, তাদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আশা-নিরাশার দোলাচলে দোলায়মান জীবনধারা, সংসার মায়াজালে মোহাবিষ্ট ত্যক্ত-বিরক্ত জীবনের বৈশিষ্ট্যময় রূপগুলি তাদের চেতনায় প্রকাশ পায় । আর তাই সাধক কবি মহানন্দ হালদার গেয়েছেন –
অ-তীর সংসার-মরু তপ্ত মোহ বালুকায়
আপনা ভুলিয়ে জীবে সদা ঘোরে অন্ধপ্রায় ॥
মায়া-মরীচিকার পিছে, জীব ঘুরে মরে মিছে
চোখে ধাঁধা লেগে আছে দেখে না নয়ন হায় মরণ-নিদাঘ করে
তপ্ত মরু আছে ঘিরে; জীবে ব্যর্থ আশা করে, মরুতে এড়াতে চায় ॥
দণ্ডে দণ্ডে বাড়ে তৃষা, ঘোর সংসার লালসা
শূন্য দৃষ্টিহারা দিশা
শুষ্ক কণ্ঠ পিপাসায়
সাধুসঙ্গ মুরুদ্যানে
স্থান পায় ভাগ্যবানে
মহানন্দ দিনে দিনে
মরুবুকে প্রাণ হারায়
মতুয়া ধর্ম গার্হস্থ্য জীবন বা সংসার জীবনের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করে থাকে । তাঁরা সন্ন্যাস গ্রহণে উৎসাহী নয়। তাঁরা নির্জন, নিরাভরণ, নিঃসীম সাধনলোকে বিচরণ করতে চায় না। মতুয়াগণ-ঠাকুর রামকৃষ্ণ যেমনটি বলেছেন, ‘সংসারে থাকতে হয় পাকাল মাছের মতো; পাকাল মাছ যেমন কাদার মধ্যে থাকে; কিন্তু গায়ে কাদা লাগে না। এমনিভাবে সংসার জীবন অতিবাহিত করতে হয়।
মতুয়াদের প্রামাণ্যগ্রন্থ শ্রীশ্রী হরিলীলামৃত-এ লেখা আছে—
গৃহে থাকি প্রেম ভক্তি সেই হয় শ্রেষ্ঠ অনুরাগ বিরাগেতে প্রেম ইষ্ট নিষ্ঠ।
গৃহেতে থাকিয়া যার ভাবোদয় হয় সেই সে পরম সাধু জানিবে নিশ্চয় ।
প্রেম, ভক্তি, ভালোবাসাই তাঁদের নিকট সর্বশ্রেষ্ঠ ।
কবি চণ্ডিদাসের বিখ্যাত সেই পঙ্ক্তির সাথে মতুয়া গীতিকারের পদ্যের মিল দেখা যায় ।
চণ্ডীদাস যেমন বলেন –
শুনহে মানুষ ভাই!
সবার উপর মানুষ
সত্য তাহার উপর নাই ।
স্বামী বিবেকানন্দ যেমন বলেছেন –
বহুরূপে সম্মুখ ছাড়ি
কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর
জীবে প্রেম করে যেই জন
সেই জন সেবিছে ঈশ্বর
মতুয়া সঙ্গীতকারও ঠিক অনুরূপভাবে গেয়ে উঠেছেন —
যার মন কাদে মন মানুষ বলে,
সে কি ঘরে রইতে পারে ।
আবার এরূপ ছত্রও দেখা যায়ঃ
মানুষ খোঁজ —
মানুষ ভজ ও আমার অবুঝ মন ।
মানুষের মেলা, মানুষের খেলা মানুষ হয় পরম রতন ।
মানুষ সত্য এ সংসারে, দেখতে পাবি প্রেম বাজারে ।
মানুষ হয় সবার উপরে, বিশ্বস্রষ্টার এই লিখন ।
মতুয়াগণ (Matua Community) ফকির লালন শাহের ন্যায় তাদের কর্ম ও চেতনার মধ্যে মানবকুলকে ভালোবাসার তাগিদ দিয়েছেন। তাঁরা যেমন বলেন, পবিত্র চরিত্র ব্যক্তির প্রতি জাতিভেদ করিও না । মতুয়াগণ একজন ব্যক্তিমানুষের আভিজাত্য, বংশমর্যাদা বা উঁচু বা নিচুবর্ণের উপর গুরুত্বারোপ করেন নাই ।
তাঁরা একটি মানুষের চরিত্র মাহাত্ম্য বা তার ভেতরের মূল্য দেখার চেষ্টা করেছেন; বাহ্যিক দিক নয়। তাঁরা বলতে চেয়েছেন, মানুষই ভগবান, এটিই সত্য।
মানুষের মধ্যেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব মতুয়াগণ অনুভব করেন। যাহোক পরিশেষে বলা যায়, মানুষের মধ্যেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব, এটিই মতুয়া মতবাদের মৌলিক মতাদর্শ ।
More Stories
সাপ থেকে বাঁচার দোয়া
সাপ স্বপ্ন দেখলে কি হয়
জাপানিজরা শত বছর বাঁচে