Colorgeo

Classroom for Geology and Disaster

অবহেলায় অপচয় মিলিয়ন টাকার যমুনা নদীর খনিজ বালি

Spread the love

স্থানঃ যমুনা নদী বেড়িবাঁধ, এনায়েতপুর এবং যমুনার চর, কৈজুরী, শাহজাদপুর।

চিত্রঃ যমুনার চর, এনায়েতপুর, সিরাজগঞ্জ

নিজ জেলার মধ্যে (সিরাজগঞ্জ) খনিজ সম্পদ নেই বললেই চলে যেটুকু বা আছে সেটা যমুনা নদীর মহামূল্যবান খনিজ বালি। এছাড়াও সরকারি ওয়েবসাইট থেকে জানা যায় সেটা হলো চৌহালী উপজেলায় মাঝে মধ্যেই প্রাকৃতিক গ্যাসের উদগিরণ হয়। এখন এই প্রাকৃতিক গ্যাস নিতান্তই পকেট গ্যাস নাকি কোন বড় মজুদের সম্ভাবনা উঁকি মারছে তা বলতে পারবো না।
সে যাই হোক, বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে, পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদী প্রবাহ দিয়ে প্রতি বছর প্রায় ১ বিলিয়ন টনেরও বেশী বালি বাংলাদেশের ভূভাগে আসছে এবং জমা হচ্ছে। এরকম বালি থেকে ৮% এর মতো ভারী মণিক উত্তোলন করতে পারলেই বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক বলে গণ্য করা হয়। অথচ আমাদের দেশে প্রাপ্ত এই বালির মধ্যে থেকে ১০%ও বেশী পরিমাণে ভারী মণিক বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলন করা সম্ভব।

চিত্রঃ কোয়ার্টজ সিলিকা আধিক্য খনিজ বালি

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে এই বালি সাড়া দেশে অপরিকল্পিতভাবে ড্রেজিং করে সস্তা দামে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। আর সেই বালিকে বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন, নদী শাসন, রোড়ওয়ে তৈরিকরণ কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। যা বাংলাদেশে খুবই সাধারণ এবং অহরহ ঘটছে। প্রতি টন বালি বিক্রি করা হচ্ছে ১০০০-২০০০ টাকার মধ্যে বা তারও কম বেশী হতে পারে।
অথচ ভাবলেও অবাক হবেই যে, Geological Survey of Bangladesh (GSB) এবং Institute of Mining, Metallurgy & Mineralogy (IMMM) এর তথ্যমতে, ব্রহ্মপুত্র-যমুনার কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার অংশের সেই এক টন বালুতে কাচ তৈরির উপাদান সর্বোচ্চ পরিমাণ,
কোয়ার্টজ সিলিকা ৫০ কেজি, এছাড়াও ভারী মণিক,
ইলমিটাইট ৬০০ গ্রাম,
জিরকন ৪০০ গ্রাম,
রুটাইল ৪০০ গ্রাম,
গার্নেট ২ কেজি ৫০০ গ্রাম
ও মোনাজাইট ১০০ গ্রাম আছে। যার মোট চলতি বাজারমূল্য ৩ লাখ ২০ হাজার ৮৯২ টাকা। অর্থাৎ ১ টন বালু থেকে ৫৪ কেজি খনিজ উপাদান আলাদা করে বিক্রি করলে বাংলাদেশ পাবে সোয়া ৩ লাখ টাকা।

চিত্রঃ ভারী মণিক মিশ্রিত বালি

১৯৮৯ সালে সর্বপ্রথম ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীতে প্রাথমিক এক সার্ভেতেই এর উপস্থিতি পাওয়া যায়। যা কুড়িগ্রাম জেলা হতে সিরাজগঞ্জ জেলার বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত বিস্তৃতি ছিলো। পরবর্তীতে ২০১৫ সালে আরও একটি সার্ভে করা হয়। যে সার্ভেতে ভারী খনিজের উপস্থিতি পাওয়া গেছে ০.১৫% থেকে ২৭.১৫% পর্যন্ত। যার গড় দাঁড়িয়েছে ৭.৮৯%। ভারী খনিজের উপস্থিতি পাওয়া গেছে ৫.২% থেকে ১৮.৩২% হারে। যার গড় হচ্ছে ১০.০৪%। এরমধ্যে ইলমেনাইট ৮.২৪% থেকে ২৫.৬৭%, গারনেট ৮.৮৬% থেকে ৩৫.২৫%, জিরকন ৬% থেকে ২৬.৮১%, রুটাইল ১.৪৪% থেকে ৯.১৯%, কেনাইটের উপস্থিতি পাওয়া গেছে ২.৭৩% থেকে ১৪.৫৩%।
এসব ভারী খনিজ দিয়ে পারমাণবিক চুল্লি থেকে শুরু করে বিভিন্ন শিল্পের অপরিহার্য উপাদান হিসাবে ব্যবহৃত হবে।
পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তাসহ অন্যান্য নদীর বক্ষে এবং বঙ্গোপসাগরে তীরবর্তী উপকূলীয় এলাকায় অঘাত পরিমাণে এরকম ভারী মণিকের উপস্থিতি আছে বলেই সেই ১৯৭৮ সাল থেকে অস্ট্রেলিয়ার, আমেরিকা, ব্রিটেন, চীন, মালেশিয়া, মালদ্বীপের মতো দেশেসমূহ প্রতিনিয়ত ওতপেতে আছে কিভাবে এই বালি রপ্তানি করে নিজ দেশে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়।
রপ্তানিতে সুবিধা না করতে পেরেই বিভিন্ন সময়ে নদী ও সমুদ্রের তীরবর্তী এলাকায় এসব দেশের কোম্পানিসমূহ এই দেশের বালি অনুসন্ধান এবং এ নিয়ে গবেষণা করেই যাচ্ছে। যার মধ্যে কার্বন মাইনিং বাংলাদেশ লিমিটেড, প্রিমিয়ার মিনারেলস লিমিটেড, এভারলাস্ট মিনারেলস লিমিটেড (বর্তমান চলমান) অন্যতম। অথচ এ দেশেরই দুইটি সরকারি সংস্থা Geological Survey of Bangladesh (GSB) এবং Bangladesh Atomic Energy Commission (BAEC) এর যথেষ্ট পরিমানে অনুসন্ধানের যোগ্যতা আছে বলে আমি মনে করি। তাহলে কি খনিজ বালি নিয়ে কোন রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতায় ভূগছে বাংলাদেশ?

দিন যতোই যাচ্ছে এইরকম খনিজ বালির প্রতিনিয়ত অপব্যবহার হয়েই চলছে। কুড়িগ্রামের কিছু অংশ থেকে এইরকম বালি সাধারণের জন্য ড্রেজিং করে উত্তোলনের নিষেধাজ্ঞা জারী করা হলেও অন্যান্য অঞ্চল থেকে কিন্তু ঠিকই অপচয় চলছেই। লাখো টাকার বালি হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যে বালি কাজে লাগানোর কথা পারমাণবিক বিদ্যুৎ তৈরীতে, কাঁচ শিল্পে অথবা এইরকম অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক কোন শিল্প ক্ষেত্রে কিন্তু সেই বালি দিয়ে আমরা কি করছি?

বাংলাদেশ সরকারের এইদিকে যতদ্রুত সম্ভব নজর প্রদান করা উচিৎ। বাংলাদেশেই এই বালি অপচয় রোধ অথবা বিদেশী কোম্পানিগুলোর হাত হতে দেশীয় সংস্থার প্রতি নজর প্রদান করা। যাতে কোন খনিজ অনুসন্ধান জরিপ বিনা ওইসব নদীর বালি ব্যবহৃত না হয় এবং যতোদ্রুত সম্ভব এই বালি ড্রেজিং মাইনিং পদ্ধতি ব্যবহার করে উত্তোলন করে দেশের উন্নয়নের বড় ভূমিকা পালন করতে পারে তার ব্যবস্থা করা।
পরিশেষে লেখক প্রমথনাথ বিশীর কথা দিলেই শেষ করতে চাই,
‘বাংলাদেশের নদীকে যে নিবিড়ভাবে জানতে পারে না, সে কীভাবে বাংলাদেশকে জানবে?’