Colorgeo.com

Disaster and Earth Science

করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন কী কীভাবে কখন

Spread the love

করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন কী কীভাবে কখন

করোনা ভাইরাস যখন প্রবল গতিতে ছড়ানোর পাশাপাশি মানুষ মেরে যাচ্ছে, বিশ্ব তখন ভাইরাসটি প্রতিরোধে কার্যকর একটি ভ্যাকসিন হাতে পাওয়ার অপেক্ষায়। টিকা তৈরির বিভিন্ন গবেষণা আর পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়ে গণমাধ্যমে আসছে অসংখ্য তথ্য। কেন এত সময় লাগছে ভ্যাকসিন পেতে? আদৌ কি আসবে ভ্যাকসিন? কার্যকর হবে তো? – এমন নানা প্রশ্ন জাগছে সাধারণ মানুষের মনে।

কবে আসবে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন?

কেউ এখনও নিশ্চিত করে তা বলতে পারছে না; তবে লক্ষ্য আগামী বছরের শুরুর দিকে হাতে পাওয়ার।

বিশ্বজুড়েই চলছে ভ্যাকসিন বের করার কর্মযজ্ঞ। এ নিয়ে একেকটি গবেষণা আছে একেক পর্যায়ে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় অ্যালার্জি ও সংক্রামক রোগ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. অ্যান্থনি ফাউচি আত্মবিশ্বাসী যে  ২০২১ সালের প্রথম প্রান্তিকে কোনো একটি ভ্যাকসিন নিরাপদ ও কার্যকর প্রমাণিত হবে।

তবে ভ্যাকসিন উদ্ভাবনে চলা গবেষণাগুলোর মধ্যে কোনটি সবচেয়ে সম্ভাবনাময় তা পরিষ্কার নয়।

এরই মধ্যে মার্কিন সরকার মডার্নার মতো বায়োটেক কোম্পানিগুলোকে ভ্যাকসিন দ্রুত উদ্ভাবনে সহায়তা করছে যাতে এটি নিরাপদে কাজ করবে প্রমাণিত হলেই যেন দ্রুত বাজারে আনা যেতে পারে।

ফাউচি বলেন, “২০২১ সালের শুরুর দিকে আমরা কয়েক কোটি ডোজ হাতে পেতে চাই।”

জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটসের পরিচালক ড. ফ্রান্সিস কলিন্সও একই রকম পূর্বাভাস দিয়েছেন। “যদি সব কিছু ঠিকঠাক হয়, তবে ২০২১ সালের প্রথম দিকে প্রায় ১০ কোটি ডোজ পাওয়া সম্ভব হবে।”

তবে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, জানুয়ারির মধ্যে কার্যকর ভ্যাকসিন হাতে পাওয়ার লক্ষ্যটা অনেক উচ্চাকাঙ্ক্ষী।

ভাইরোলজি, ইমিউনোলজি এবং ভ্যাকসিন উন্নয়নে বিশেষজ্ঞ ড. ল্যারি কোরি বলেন, “এই লক্ষ্য সম্ভব করতে হলে সবকিছুই অবিশ্বাস্যভাবে নিখুঁত হতে হবে।”

ভ্যাকসিন
ভ্যাকসিন

ভ্যাকসিন তৈরিতে এত সময় লাগে কেন?

ভ্যাকসিন কার্যকর এবং নিরাপদ কিনা তা নিশ্চিত করতে অনেক ধাপের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় অ্যালার্জি ও সংক্রামক রোগ ইনস্টিটিউটের (এনআইএআইডি) সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. এমিলি আরবিল্ডিং জানান, সাধারণত একটি টিকা তৈরি করতে আট থেকে ১০ বছর সময় লাগে।

মাম্পসের টিকা তৈরি করতে সময় লেগেছিল চার বছর। সংক্রামক রোগের ইতিহাসে এটাকেই সবচেয়ে দ্রুত ভ্যাকসিন তৈরি করার উদাহরণ হিসেবে ধরা হয়।

ভ্যাকসিন তৈরিতে সময় লাগার অনেক কারণও আছে। সম্ভাব্য একটি ভ্যাকসিন তৈরি করার পর সাধারণত মানুষের আগে প্রাণীর ওপর পরীক্ষা করা হয়। ফল আশানুরূপ হলে মানুষের ওপর তিন পর্যায়ে পরীক্ষা শুরু হয়।

প্রথম পর্যায়ে একটি ছোট দলের সবাইকে টিকা দিয়ে দেখা হয় এটি নিরাপদ কিনা। কখনও দেখা হয়, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা কীভাবে সাড়া দেয়। সব ঠিকঠাক থাকলে গবেষকরা পরের ধাপে যান।

দ্বিতীয় পর্যায়ে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা বাড়ানো হয়, সাধারণত যা প্রায় একশ জনের মতো হয়। ঝুঁকিতে থাকা সদস্যদের সংখ্যাও বাড়ানো হয়। বিভিন্ন বয়সের ও শারীরিক অবস্থার অংশগ্রহণকারী থাকে এই ট্রায়ালে, বিশেষ করে যাদের জন্য নতুন ভ্যাকসিনটি আনা হচ্ছে। ফল আশাব্যঞ্জক হলে তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল শুরু হয়।

তৃতীয় ধাপে হাজার হাজার মানুষের মধ্যে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা এবং নিরাপত্তার দিকটি পরীক্ষা করা হয়। এ ধাপে গবেষকরা ভ্যাকসিনের সম্ভাব্য বিরল পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে কিনা বোঝার চেষ্টাও করেন।

দ্রুত ভ্যাকসিন আনতে চাইলে ঝুঁকি কি?

ইতিহাস বলে তাড়াহুড়ো করে ভ্যাকসিন আনলে পরিণতি ভালো হয় না। ২০১৭ সালে ফিলিপিন্সে মশাবাহিত ডেঙ্গুর জন্য প্রায় ১০ লাখ শিশুকে টিকা দেওয়ার একটি কর্মসূচি নিরাপত্তাজনিত কারণে বন্ধ করা হয়। টিকা নেওয়া ১০টি শিশু মারা যাওয়ার ঘটনায় ১৪ কর্মকর্তাকে অভিযুক্ত করে সরকার বলেছিল, তাড়াহুড়ো করে এই কর্মসূচি চালু করা হয়েছিল।

১৯৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে সোয়াইন ফ্লুর প্রাদুর্ভাব নিয়ে কাজ চলার সময় সরকার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি সতর্কতা উপেক্ষা করে নতুন ভাইরাসের বিরুদ্ধে “যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি পুরুষ, মহিলা এবং শিশুকে” টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা নেয়। ৪ কোটি ৫০ লাখ মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়ার পর গবেষকরা দেখেন, প্রায় ৪৫০ জনের মধ্যে বিরল একটি ব্যাধি দেখা দিয়েছে, যাতে দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নার্ভগুলোকে আক্রমণ করে এবং পক্ষাঘাতের দিকে নিয়ে যায়। এদের মধ্যে মারা যায় কমপক্ষে ৩০ জন।

নিরাপদেই কীভাবে টিকা তৈরির প্রক্রিয়ার গতি বাড়ানো যায়?

জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটসের পরিচালক কলিন্স বলেন, “‘এটা কি নিরাপদ’ এবং ‘এটা কি আপনাকে রক্ষা করবে’ – এই দুটি দিক খুব ভালোভাবে পরীক্ষা না করে কোনো ভ্যাকসিনই বাজারে আনা হবে না।”

বিজ্ঞানীরা সাধারণ প্রক্রিয়াগুলোর গতি বাড়ানোর নিরাপদ উপায় খুঁজতে চেষ্টা করছেন। সিয়াটল এবং আটলান্টায় গবেষকরা মানুষের আগে প্রাণীদের পরীক্ষার নিয়মের পরিবর্তে প্রাণী ও মানুষের মধ্যে একই সময়ে পরীক্ষা করার পরিকল্পনা করেছিলেন।

আবার ট্রায়াল শেষ হওয়ার আগেই কিছু ভ্যাকসিন প্রচুর পরিমাণে তৈরি করে রেখে দেওয়া যেতে পারে। ফাউচি বলেন, “আমরা ভ্যাকসিনগুলো কাজ করে কিনা তা জানার আগেই উৎপাদন শুরু করতে যাচ্ছি।”

যদি ভ্যাকসিনের পরীক্ষাগুলো সফল হয়, লাখ লাখ ডোজ আগেই প্রস্তুত থাকবে। উৎপাদনের জন্য কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে না। ভ্যাকসিনগুলো সঙ্গে সঙ্গেই জীবন বাঁচাবে। তবে পরীক্ষাগুলো সফল না হলে আগেই তৈরি এই ভ্যাকসিনগুলো ফেলে দিতে হতে পারে।

ফাউচি জানান, এনআইএআইডি -এর সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে বায়োটেক কোম্পানি মডের্নার একটি ভ্যাকসিন গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময়ে চূড়ান্ত ধাপের পরীক্ষায় যাবে। এগুলো কাজ করবে কিনা সেটা পরিষ্কার হওয়া আগেই ভ্যাকসিনের ডোজ উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে। নভেম্বর বা ডিসেম্বরের মধ্যে প্রায় ১০ কোটি ডোজ তৈরি করা হবে।

ভ্যাকসিনটি কাজ করবে কিনা তা নির্ধারণের জন্য নভেম্বর বা ডিসেম্বরের মধ্যে বিজ্ঞানীদের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য থাকা উচিত বলে ফাউচি মনে করেন।

যুক্তরাজ্যের কোম্পানি অ্যাস্ট্র্যাজেনেকাও ভ্যাকসিন তৈরির কাজ করছে একই সময়সূচি অনুসরণ করে।

ভ্যাকসিনের দাম কত হবে?

এটি এখনও বোঝা যাচ্ছে না। সাহায্য সংস্থা ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস কোনো লাভ ছাড়াই উৎপাদন মূল্যে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন বিক্রি করার জন্য ওষুধ কোম্পানিগুলোকে চাপ দিতে বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।

ভ্যাকসিন নীতি নিয়ে সংস্থাটির জেষ্ঠ্য উপদেষ্টা কেইট এলডার বলেন, “মনে হচ্ছে সবাই একমত যে আমরা এখানে ব্যবসার সাধারণ নিয়মগুলো প্রয়োগ করতে পারি না, যেখানে সবচেয়ে বেশি অর্থ খরচ করতে পারা দেশ শুরুতেই তাদের জনগণকে রক্ষা করতে পারবে আর বিশ্বের বাকি মানুষরা পেছনে পরে থাকবে।”

কতটা কার্যকর বা দীর্ঘস্থায়ী হবে ভ্যাকসিন?

সব রোগের ভ্যাকসিন কিন্তু সমানভাবে কাজ করে না। পোলিওর টিকা একবার দেওয়া হলে সাধারণত পুরো জীবনের জন্য সুরক্ষা পাওয়া যায়। আবার কোনা মৌসুমের শুরুতে ফ্লু শট বা সাধারণ ফ্লু প্রতিরোধের টিকা নেওয়ার পরও ওই মৌসুমেই রোগটি দেখা দিতে পারে। আর পরের মৌসুমে তো আবার আলাদা ফ্লু শট নেওয়া লাগেই। কারণ সাধারণ ফ্লুর ভাইরাস দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে যায় বলে প্রতিবছর নতুন ফ্লু ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়।

গবেষকরা এই মুহূর্তে বলছেন, করোনাভাইরাসের কোনো ভ্যাকসিন কতটা কার্যকর বা দীর্ঘস্থায়ী হবে তা অনুমান করার উপায় নেই।

তবে প্রায়োজনীয় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা পেতে একাধিক ডোজ প্রয়োজন হতে পারে। কলিন্স জানান, তৃতীয় ধাপের ট্রায়ালে বোঝা যাবে একটি না দুটি ইঞ্জেকশনের প্রয়োজন হবে।