Colorgeo.com

Disaster and Earth Science

পার্মিয়ান সময়ের গণবিলুপ্তি দুর্যোগের আদ্যোপান্ত

Spread the love

পার্মিয়ান সময়ের গণবিলুপ্তি দুর্যোগের আদ্যোপান্ত

আজ থেকে ২৫২.০৯ মিলিয়ন বা ২৫.২০ কোটি বছর আগের কথা পৃথিবীতে একটি বৃহৎ দুর্যোগ ঘটেছিল। সেই দুর্যোগ এর নাম পার্মিয়ান গণবিলুপ্তি দুর্যোগ সেই সময়ে পৃথিবীর 90% প্রাণী মারা গিয়েছিল এবং স্থলভাগের 70% প্রাণীর মারা যায়। যা পৃথিবীর ইতিহাসে এযাবৎকালের সব থেকে বেশি প্রাণী মারা যাওয়ার ঘটনা।

বিজ্ঞানীরা এই বৃহৎ প্রাগৈতিহাসিক কে নিয়ে বিস্তর গবেষণা করে যাচ্ছেন। এই দুর্যোগ মূলত ঘটেছিল কয়েকটি কারণে তার মধ্যে এযাবতকালের সবথেকে বেশি প্রমাণযোগ্য বাস্তব তথ্য উপস্থাপন করার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে বর্তমান সাইবেরিয়াতে তৎকালীন সক্রিয় আগ্নেয়গিরি থেকে দীর্ঘস্থায়ী অগ্নুৎপাতের ফলে সৃষ্ট লাভাস্রোত ভূপৃষ্ঠের বিস্তর জায়গা নিয়ে প্লাবিত হওয়ার মাধ্যমে পৃথিবীর আবহাওয়া ও সামুদ্রিক পরিবেশের যে পরিবর্তন সাধিত হয় সেটাই হলো মূলত এই পার্মিয়ান মহাদুর্যোগের প্রধান কারণ।

পার্মিয়ান মহা দুর্যোগ মূলত সামুদ্রিক প্রাণীদের ধ্বংস ও স্থলভাগের প্রাণীদের ধ্বংস করেছিল।

সমুদ্রের প্রাণীদের একটা বৃহৎ অংশ মারা গিয়েছিল। বর্তমান সাইবেরিয়াতে অবস্থিত সক্রিয় আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে প্রথমে পৃথিবীর একটা বৃহৎ পরিবর্তন হয় এটাকে বর্তমান সময়ের অতি পরিচিত বৈশ্বিক উষ্ণতার চরম অবস্থা বলা হয়। অগ্ন্যুৎপাতের ফলে লাভা থেকে যে কার্বন ডাই অক্সাইড বা অন্যান্য গ্রীন হাউজ গ্যাস সহ সালফার ডাই অক্সাইড বায়ুমন্ডলে যুক্ত হয় এই সালফার-ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলের পানির সাথে যুক্ত হয়ে অ্যাসিড বৃষ্টি হয় ।

এভাবে দীর্ঘস্থায়ী বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও এসিড বৃষ্টির কারণে পৃথিবীর স্থলভাগের গাছপালার সাধিত হয় এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। পৃথিবীর গাছপালা স্থলভাগের বিস্তর অঞ্চলজুড়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার প্রমাণ বর্তমান অস্ট্রেলিয়া, চীন ও অন্যান্য দেশ থেকে গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ পাওয়া যায়। স্থলভাগের গাছপালা ধ্বংস হলে সহজেই মাটি ক্ষয় সাধন হয় যার কারণে সময়ের ব্যবধানে এগুলো পানির সাথে মিশে সমুদ্রে পতিত হয়।

অধিক পরিমান এই মাটির ক্ষয় প্রাপ্ত খনিজ পদার্থগুলো সমুদ্রের পানিতে মিশে অধিক পরিমাণে অতিক্ষুদ্র এলজি জাতীয় অনুজীব তৈরি করে যার ফলে সমুদ্রের পানিতে অক্সিজেন এর ঘাটতি দেখা যায়। এভাবে সমুদ্রের পানিতে অক্সিজেনের ঘাটতি হওয়ার ফলে সামুদ্রিক প্রাণী যেমন মাছ ও অন্যান্য প্রাণীগুলোর জীবন বিপন্ন হয় এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়াতে প্রাণী গুলো মারা যায়।

পার্মিয়ান
পার্মিয়ান সময়ের গণবিলুপ্তি দুর্যোগের আদ্যোপান্তঃ প্রাগৈতিহাসিক ম্যাপ

সমুদ্রের প্রাণী গুলো বিলুপ্তি হওয়ার জন্য বিজ্ঞানীরা আরো কয়েকটি কারণ দেখিয়েছেন এর একটি হলো সমুদ্রের তলদেশে অবস্থিত অগ্ন্যুৎপাতের ফলে গ্যাস পানির সাথে মিশে যাওয়া গ্যাস ও সমুদ্রের তলদেশে জমাকৃত মিথেন গ্যাস উদগীরণ হওয়ার মাধ্যমে পানিতে মিশে সমুদ্রের প্রাণীদের জীবন বিপন্ন করে। সমুদ্রের পানি অধিকতর অম্ল হয়ে যাওয়া একটা অন্যতম প্রধান। কারণ বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন সমুদ্রের প্রাণীগুলোর বিপর্যয়ের জন্য সুনির্দিষ্ট একটি কারণ দায়ী নাও হতে পারে। সমস্ত ঘটনাগুলো একটি আরেকটির সাথে সম্পর্কযুক্ত অর্থাৎ বিপর্যয় সৃষ্টিকারী কারণগুলো একটির সাথে একটি সম্পর্কযুক্ত।

দীর্ঘ সময়ের প্রেক্ষিতে সমুদ্রের প্রাণীগুলোর বিলুপ্তি হতে পারে। পার্মিয়ান সময়ের সামুদ্রিক উপরিভাগের তাপমাত্রা বর্তমান বিশ্বের সমুদ্রের তাপমাত্রা থেকে ৮ থেকে ১২ ডিগ্রী সেলসিয়াস বেশি হয়ে গিয়েছিল যার কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের সাধারণ গড় তাপমাত্রা বেশি হওয়ার জন্য সমুদ্রের প্রাণীগুলোর বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে প্রাণী গুলো মারা যায়। সাইবেরিয়ার আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত পার্মিয়ান সময়ের সমুদ্র ও স্থলভাগের প্রাণীগুলো বিলুপ্তির জন্য প্রধান নিয়ামক।

বিজ্ঞানীরা দেখেছেন সাইবেরিয়ার অগ্নুৎপাত প্রথমে স্থলভাগের গাছপালা ধ্বংস করে পরবর্তীতে এর প্রভাব সমুদ্রের প্রাণীগুলোর জীবন বিনষ্ট করে। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে বয়স নির্ধারণ করেছেন যে সমুদ্রের প্রাণীগুলোর বিপর্যয় এবংস্থলভাগের গাছপালা ও প্রাণীগুলোর ধ্বংস দুটি পৃথক ঘটনা। এই দুটি পৃথক দুর্যোগ দুটি আলাদা সময় ঘটেছে। এ দুটি মহাদুর্যোগের মধ্যে সময়ের ব্যবধান তিনশো সত্তর হাজার বছর। পার্মিয়ান সময়ের সমুদ্রের প্রাণীগুলোর গণবিলুপ্তি ঘটেছিল আজ থেকে 25.2 কোটি বছর আগে এবং এর ঠিক তিনশো সত্তর হাজার বছর পুর্বে স্থলভাগের প্রাণী ও গাছপালার ধ্বংস হয়।

এ দুটি ঘটনা সাইবেরিয়ার আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের লাভাস্রোত এর দীর্ঘস্থায়ী প্লাবিত হওয়ার ঘটনার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পৃথিবীতে এক সময় ডাইনোসর বসবাস করত। এটা আমরা সবাই জানি। ডাইনোসর আজ থেকে 6.6 কোটি বছর আগে পৃথিবীতে বসবাস করত এবং মহাশূন্য থেকে আগত উল্কাপাতের হলে ডাইনোসরের বিলুপ্তি হয়।

ডাইনোসর বিলুপ্ত হওয়ার আগে পার্মিয়ান সময়ের বিলুপ্তির ঘটনা ঘটে যা কিনা 25.2 কোটি বছর আগের ঘটনা। পার্মিয়ান সময়ে স্থলভাগের যেসব প্রাণী বসবাস করত তারমধ্যে অন্যতম হলো ডিসাইনডনট, লিসটসোরাস ইত্যাদি। এগুলো তৃণভোজী প্রাণী।পার্মিয়ান সময়ের গণবিলুপ্তি, ডাইনোসরের গণবিলুপ্তি সহ প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে এমন মহা বিপর্যয় পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত পাঁচবার ঘটেছে।

বর্তমান পৃথিবীর বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, মানুষ সৃষ্ট কারণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনে পরিবেশের পরিবর্তন ও অন্যান্য কারণে বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে ষষ্ঠ গণবিলুপ্তি পৃথিবীতে ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন ষষ্ঠ গণবিলুপ্তি বা সিনজোয়িক গন বিলুপ্তি পৃথিবীতে প্রাণের আবির্ভাব এবং ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ঘটনা একটা প্রাকৃতিক নিয়ম।

ঠিক এভাবেই ষষ্ঠ গণবিলুপ্তি ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। মানুষের সৃষ্ট প্রযুক্তির উন্নতি ও অধিকহারে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি বর্তমান পৃথিবী কে অনেক ভাবিয়ে তুলেছে। সেজন্য বিজ্ঞানীরা হুঁশিয়ারি করে দিয়েছেন যে ষষ্ঠ বিলুপ্তির হার পৃথিবীর ইতিহাসে অতীতের ঘটে যাওয়া গণবিলুপ্তি প্রাণীর থেকে তুলনামূলক ভাবে দ্রুততর।

তাই ষষ্ঠ বিলুপ্তির হাত থেকে পৃথিবী কে বাঁচানোর জন্য মানুষকে এখনই সজাগ হতে হবে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি রোধ করতে হবে এবং মনুষ্য সৃষ্ট কারণে যাতে এই পরিবর্তন ত্বরান্বিত না হয় সেজন্য সচেতন থাকতে হবে পৃথিবীর মানবজাতিকে ষষ্ঠ গণবিলুপ্তি থেকে রক্ষা করতে।