Colorgeo.com

Disaster and Earth Science

ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত

Spread the love

ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত

আধুনিক কালে ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীতকে বিশৃঙ্খলার পংকোদ্বার হতে উদ্ধার করার জন্য ভারতবর্ষে ২ জন মহাপুরুষ এর আবির্ভাব ঘটেছিল। তাদের মধ্যে একজন হলেন পণ্ডিত বিষ্ণু নারায়ণ ভাতখন্ডে। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের ১০ই আগষ্ট বোম্বাই এর বালেশ্বর নামক স্থানে তাঁর জন্ম হয়।ছোটবেলা থেকেই তিনি মায়ের নিকট ভজন গান আর কাশীর বিখ্যাত বমন দাস এর নিকট সেতার শিখেছিলেন। যদিও বাল্যকালে তার অবহেলা ছিল না লেখাপড়ায়।

১৮৮৩ খিস্টাব্দে তিনি তাঁর মেধাশক্তি দিয়ে বি এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে এল এল বি পাশ করেন।স্বভাবতই ছোটবেলা থেকে সঙ্গীতের প্রতি ছিল তাঁর গভীর অনুরাগ, আর সেকারণেই ব্যারিস্টারি পেশায় না এসে তিনি সঙ্গীতের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সঙ্গীত সাধনায় মনোনিবেশ করেন।

তখন থেকে তিনি তৎকালীন প্রসিদ্ধ ধ্রুপদীয়া জাকিরুদ্দিনের নিকট বহু ধ্রুপাদ গান আর আসেখ আলী ও মুহম্মদ আলীর নিকট বহু খেয়াল শিখে আলোড়ন সৃষ্টি করে ফেলেছিলেন ভারতবর্ষে। যে কোনো গান শোনা মাত্র তিনি তা নিজের আয়ত্ত্ব করে ফেলতে পারতেন বলে,গুণী সমাজ তাঁকে “চতুর” বলে সম্বোধন করতেন।

ধ্রুপদ সংগীত কি

ধ্রুপাদ হল হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একটি প্রাচীনতম এবং গুরুগম্ভীর ধারা। এটি সাধারণত ধ্রুপদী গানের এক প্রকার যা ধীরে ধীরে গাওয়া হয় এবং এতে লয় এবং তাল বিশেষ গুরুত্ব পায়। ধ্রুপাদ গানের মূল উপাদান হলো “আলাপ,” যা গানের শুরুতে দীর্ঘ ও ধীর লয়ে পরিবেশন করা হয়, এবং “বন্দিশ,” যা মূল গানের অংশ। ধ্রুপাদ সাধারণত ধর্মীয় বা পবিত্র বিষয়বস্তু নিয়ে লেখা হয় এবং মাটির নিচু সুরে পরিবেশিত হয়, যা ধ্রুপাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের খ্যাতির কারণ:

ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত বিশ্বের প্রাচীনতম এবং সবচেয়ে সমৃদ্ধ সঙ্গীত ঐতিহ্যগুলির মধ্যে একটি। এটি তার অনন্য বৈশিষ্ট্য, জটিল সুর, এবং আধ্যাত্মিক গভীরতার জন্য বিখ্যাত।

 

  • প্রাচীন ঐতিহ্য: ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ইতিহাস ৫,০০০ বছরেরও বেশি পুরনো। এটি বেদ, হিন্দু ধর্মগ্রন্থ, এবং নাট্যশাস্ত্র, প্রাচীন নাট্যশাস্ত্রের সাথে সম্পর্কিত।
  • স্বরবন্ধনী এবং রাগ: ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ‘স্বরবন্ধনী’ নামক একটি অনন্য সুর ব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে তৈরি, যা সাতটি স্বর (নোট) এবং তাদের মধ্যে ব্যবধান (microtones) ব্যবহার করে। ‘রাগ’ নামক সুরের সংমিশ্রণ ব্যবহার করে বিভিন্ন আবেগ ও ভাব প্রকাশ করা হয়।
  • তাল এবং লয়: ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত তাল এবং লয়ের উপর জোর দেয়। তবলা, সিতার, এবং তানপুরা সহ বিভিন্ন তালবাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে তাল তৈরি করা হয়।
  • Improvisation: ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে improvisation একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। শিল্পীরা রাগের ভিত্তিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সুর তৈরি করেন, যা প্রতিটি অভিনয়কে অনন্য করে তোলে।
  • আধ্যাত্মিক গভীরতা: ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে প্রায়শই আধ্যাত্মিক অনুশীলন হিসেবে দেখা হয়। মনে করা হয় যে সঙ্গীত শ্রোতাদের মনকে শান্ত করতে এবং তাদের আত্মাকে উন্নত করতে পারে।

ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কিছু বিখ্যাত ঘরানা:

  • হিন্দুস্তানী: উত্তর ভারতে বিকশিত, খ্যাতিমান শিল্পীদের মধ্যে রয়েছেন বিমলেন্দ্র শঙ্কর সামন্ত, কিশোরী অমন আলি খান, এবং জসরাজ।
  • কারণাটিক: দক্ষিণ ভারতে বিকশিত, খ্যাতিমান শিল্পীদের মধ্যে রয়েছেন এম.এস. সুব্বুলক্ষ্মী, টি.এন. রাজারামানুজ আইয়্যার এবং ডি.কে. পদ্মনাভ।
  • ধ্রুপদ: উত্তর ভারতে বিকশিত, প্রাচীনতম ঘরানাগুলির মধ্যে একটি, খ্যাতিমান শিল্পীদের মধ্যে রয়েছেন ফতেহ আলী খান, বাদশাহ খান এবং ঋণা দেবী।

ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় এবং সমাদৃত। এটি UNESCO দ্বারা একটি অসাধারণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসাবে স্বীকৃত হয়েছে।

শাস্ত্রীয় সঙ্গীত
শাস্ত্রীয় সঙ্গীত


১৯০৪ খ্রিস্টাব্দেই পণ্ডিতজীর ঐতিহাসিক সঙ্গীত যাত্রা শুরু হয়।আর তখনকার উচ্চাঙ্গ সংগীত এর নানারূপ বিশৃঙ্খলা আর এর অন্তিম অবস্থা দেখে তাঁর মন বিচলিত হয়ে ওঠে, তা প্রতিরক্ষার জন্য তিনি উদ্গ্রীব হয়ে পড়েন।তিনি নিজ চেষ্টায় নিজ অর্থ ব্যয়ে লাঞ্ছনা স্বীকার করে অনেক প্রদেশ, রাজ্য ঘুরে প্রাচীন সঙ্গীত সাহিত্য খুঁজে তাঁর উদ্ধার এর প্রয়াস চালান।

এটা করেই ক্ষান্ত হন নি, তিনি নিজে নিজে বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞের দুয়ারে ঘুরে নিজে তাদের নিকট হতে সঙ্গীত শুনে, শিখে হিন্দুস্তানী সঙ্গীত পদ্ধতিতে তার স্বরলিপি করে “ক্রমিক পুস্তক মালিকা” নামে ৬টি খন্ডে বিভক্ত করেন যা ভারতীয় সসঙ্গীত জগতে অমূল্য দান বলে স্বীকৃত।

ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এর বিকাশ

এছাড়া তিনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের উপর মারাঠি ভাষায় ৪ খন্ডে বিভক্ত “সঙ্গীত পদ্ধতি” রচনা করেন এবং সংস্কৃত ভাষায় “অভিনব রাগ মঞ্জুরী” আর “লক্ষ সঙ্গীত” নামে ২ খানা গ্রন্থ প্রকাশ করেন। শাস্ত্রীয় বা উচ্চাঙ্গ সংগীত এর উন্নতিকল্পে তিনি ঠাট বিলাবলকে শুদ্ধ মেনে রাগ পদ্ধতি স্বীকার পূর্বক সে রাগ গুলোকে ঠাট অনুযায়ী ১০ টি ভাগে ভাগ করেন।বিলাবল,ইমন,খাম্বাজ, কাফি,ভৈরব,ভৈরবী, আশাবরী, পূরবী, তোড়ি।



তারপর তিনি এই রাগ রাগিণী সম্বন্ধে মতভেদ এর সমাধান এবং তাঁর সুষ্ঠু ও যথাযথ প্রচারকার্যে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে, সসর্বপ্রথম বরোদায় এক মহান সঙ্গীত সম্মেলন এর আয়োজন করেন যা উদ্ভোদন করেন  সেখানকার মহারাজা স্বয়ং।

আর সেই সম্মেলনে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত এর প্রসারকল্পে  শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতজ্ঞ আর গণ ভারতের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সম্বন্ধে বিশদ আলোচনা বক্তৃতা হয় আলোচনা শেষে সর্বসম্মতিক্রমে “অল ইন্ডিয়া মিউজিক একাডেমী” নামে আর বরোদা সঙ্গীত মহাবিদ্যালয় নামে সঙ্গীত মহাবিদ্যালয় স্থাপন এর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেন।

তাঁর সম্মেলন এর এই মহামূল্যবান ভাষণ গুলো  ইংরেজিতে “এ শর্ট হিস্টোরিক্যাল সার্ভে অফ্ দি মিউজিক অফ্ আপার ইন্ডিয়া” নামক পুস্তক আকারে প্রকাশিত করা হয়েছিল। এভাবে তিনি দিল্লী,লখ্নৌ, বেনারস প্রভৃতি স্থানে সঙ্গীত সম্মেলন করেন।সঙ্গীতের যথোচিত প্রচারকল্পে তিনি লখ্নৌতে “লখ্নৌ মরিস মিউজিক কলেজ” এবং গোয়ালিয়রে “মাধব সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়” স্থাপন করেন।

পরবর্তীতে তাঁর মৃত্যুর পর পুণ্য স্মৃতি রক্ষার্থে তাঁর নামের অনুকরণে  “লখ্নৌ মরিস মিউজিক কলেজ” নাম পরিবর্তন করে “ভাতখন্ডে সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়” নামকরণ করা হয়।



পন্ডিতজী অক্লান্ত পরিশ্রম আর নিজ প্রচেষ্টায় ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের মহান সেবা দিয়ে গেছেন। অবশেষে ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে সেপ্টেম্বর তিনি ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত জগত ও পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন। ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীত আর শাস্ত্রীয় সঙ্গীত জগতে এই মহাপুরুষ তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টার ফলে তাঁর মৃত্যুর পর ও উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে আছেন,যার অনস্বীকার্য অবদাম বিশ্ব ব্যাপী বিস্তৃত এখন।

ইতিহাসে ভাতখন্ডের যে অবদান ছিল তা তাঁর মহাপ্রস্থান এর পরেও নিষ্প্রভ উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত এর জগতে এক নব যুগের সৃষ্টি করে নতুন প্রাণের সঞ্চার তৈরী হয়েছিল। ইতিহাস এখনও তাঁকে আর তাঁর এই চির অম্লান  অবদানকে  শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।