মুক্তি || নিয়াজ মোর্শেদ হিমু
———————–
দরগা মসজিদ থেকে ভেসে আসছে ফজরের আযান। পাখির কলরবে চারিদিক যেন মুখরিত। হাতে তসবি নিয়ে মসজিদের দিকে যাচ্ছে কিছু ধার্মিক মুসলমান, তারই পাশ দিয়ে বইঠা হাতে পদ্মাপারের দিকে যাচ্ছে একদল জেলে। জীবিকার টানে বিছানা ছেড়ে আসতে একটুও কুণ্ঠিতবোধ হয় নি তাদের। এ যেন পদ্মাপারের জেলেদের নিয়মিত চিত্র। কুদ্দুস মিয়া এদের দলেরই একজন। এক ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে তার ছোট সংসার। কিন্তু অভাব-অনটনে তাকে প্রায়ই ধার-দেনা করে চলতে হয়। দারিদ্র্যের কষাঘাতে জীবন যেন বিপন্ন তার।
আজকে কুদ্দৃুস মিয়া একটু আগেই বের হয়েছেন। অন্যদিনের চেয়ে প্রয়োজনটা আজ বেশি তার। তার বড়ো মেয়ে জয়া অসুস্থ। আগামীকাল অপারেশনের লাস্ট ডেট। ডাক্তার বলেছেন আজকের মধ্যে টাকা জমা দিতে না পারলে তার মেয়েকে বাচানো সম্ভব হবে না।
এদিকে ঘরে চাল/ডালও কিছু নেই। দুদিন হলো প্রায় অনাহারেই দিন কাটছে তার পরিবারের।
আকাশভাঙা চিন্তা নিয়ে কুদ্দুস মিয়া জাল ফেলছেন কিন্তু জালে মাছ ধরছে না। মাছগুলো আজ কেমন যেন অচেনা হয়ে গেছে ডাকলে সাড়া দিচ্ছে না। পূর্ব আকাশে সূর্য উঠেছে। হালকা রোদের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তবুও কুদ্দুস মিয়া থেমে নেই। এমন সময় তার ছেলে কিরণ এসে বলছে,
-আব্বা! বেলা উইঠা গেছে। বাজারে লন। তাছাড়া বেশি দামে মাছ বেচবার পারুম না।
এ কথা শুনে শ্মশানচারী আত্মাটা হঠাৎ ক্ষেপে উঠল কুদ্দুস মিয়ার। কষে এক চড় দিলেন তার ছেলেকে।তারপর বলে উঠলেন,
-চইলা যা আমার চোখের সামনে থেইকা। তুই আইসোস বইলাই মাছ পাই নাই। খোদা আমার ঘরে জালেম জন্মাইছে।
এসব বলে নিজেকে একটু সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলেন কুদ্দুস মিয়া। কিন্তু নিদারুণ এক ব্যাথা তাকে বারবারই মনে করিয়ে দিচ্ছে সে একজন কাপুরুষ। যে নিজের মেয়ের চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতে পারে না। পরিবারের ভরণপোষণ করতে পারে না, দুবেলা খাবার জোটাতে পারে না। তার এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। তার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো। খোদা গরীবের ঘরে এতো রোগবালাই কেন’ই বা দেয়। তার কি কোনো মায়াদয়া নেই?
ওদিকে চোখ মুছতে মুছতে কিরণ বাড়ির পথে হাটছে। মনে মনে সে বাবাকে অনেক গালি দিচ্ছে। তারও স্রষ্টার ওপর অনেক ক্ষোভ। খোদা কেন তাকে এতো গরীব ঘরে জন্ম দিলো? কেন বড়লোকের ঘরে জন্ম দিল না? নানাপ্রশ্নে ছলছল চোখে কিরণ আজ বড়োই কাতর।
সকালের সূর্যটা গড়িয়ে দুপুর হয়ে আসছে। তবুও কিরণ তার বাবার পথ চেয়ে আছে। কখন সে বাজারে গিয়ে মাছ বিক্রি করবে? কখন সে চাল/ডাল কিনে আনবে? কখন সে একটু পেটপুরে খাবে? বাজারের পাশে একটা মস্ত বড়ো বট গাছের নিচে কিরণ বসে আছে তার বাবার অপেক্ষায়। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম খেলায় তার অপেক্ষা যে আজ দীর্ঘ হতে চলেছে সেদিকে তার কোনো নজর নেই। দুপুর গড়িয়ে বিকেল পেড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। তবুও একবুক আশা নিয়ে কিরণ বসে আছে। কিন্তু ওদিকে হয়তো মু্ক্তির উপায় খুঁজতে অজানাতে পাড়ি জমিয়েছেন কুদ্দুস মিয়া। কুদ্দুস মিয়াকে আর কখনো এ পথ দিয়ে ফিরতে দেখা যায় নি।
কিরণ আর কিছুক্ষণ ধরে কুদ্দুস মিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় তার বাবাকে জড়িয়ে দেওয়া একটি ক্ষোভ-ভরা মুখ। তার হৃদয়ে একটি প্রচন্ড অনুমান জেগে ওঠে। সে বুঝতে পারে তার ছেলের অসাধারণ বৃদ্ধির পেছনে কী বাস্তবিক কারণ ছিল। কুদ্দুস মিয়া যদি মাছ ধরতে না গিয়ে অন্য কাজে সময় ব্যয় করতে তাহলে সে কিরণের চিকিৎসা জনিত খরচের সমস্যার সামনে সামর্থ্য হতো? বা শ্মশানের প্রশাসন করে অধিক টাকা উপার্জনে সাহায্য করতে পারতো।
এই সময়ে কুদ্দুস মিয়া মনে করে, তার ছোট সন্তানের জন্য প্রকৃত ভাবেই এখন কিছু করা সম্ভব নয়। প্রায় একটা দিনে কেবল মাছ ধরে তার পরিবারের সার্বিক প্রয়োজনীয় খরচ পূরণ করা অসম্ভব হয়ে গিয়েছে। এখন তার মাথা তুলতে হবে।
তাহলে কী করা উচিত? কুদ্দুস মিয়ার মনে একটি চিন্তা জেগে ওঠে। সে খুদের সাথে মিলিয়ে জনগণের সাহায্যে মাছ ধরতে যাবে। একটি সময়ে একজনের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ কিন্তু যদি অনেকে সাথে মিলিয়ে কাজ করে, তবে প্রতিটি মানুষের জন্য অপার শক্তি জন্মায়। তার স্বপ্নে একটি সামাজিক সমাজ সৃষ্টির আবেগ জেগে ওঠে।
সে সকলের কাছে মিলিয়ে একটি সংগঠন গড়ে, যার মাধ্যমে দুর্বিপথ পথিকদের সাহায্য করতে পারবে। মাছ ধরতে গিয়ে পাওয়া সমস্ত আয় সংগঠনের তাকে ব্যবহার করা হতো তার ছোট মেয়ের চিকিৎসার খরচের জন্য।
কিছুক্ষণ পর কুদ্দুস মিয়ার চেহারা জ্বলছে উদ্দীপনা এবং নিদারুণ ক্ষোভের প্রতীক্ষা। এই পর্যাপ্ত সময়ে সে মনে করে, আত্মার শক্তি আরও বৃদ্ধি পেয়েছে, যার মাধ্যমে তিনি সামর্থ্য অর্জন করতে পারবেন তার পরিবারের জন্য সম্পূর্ণ সহায়তা করার। একটি নতুন দিকে মোড় নেয় তার জীবনের পথ।
সম্প্রতি, কুদ্দুস মিয়ার সংগঠন অনেক সাহায্য ব্যক্তিগত সাহায্যের জন্য একটি করিকরি অনুরোধ শুরু করেছে। সে আশা করে, মানুষের মধ্যে ভালোবাসা এবং উদারতা জাগানোর মাধ্যমে এই সাহায্যের কাজ সম্ভব হবে। তার মনে প্রচুর উত্সাহ আরোহিত হয়ে যায় এই নতুন পথে সারিয়ে কাজ করতে।
এই গল্পের শেষ পর্বে, কুদ্দুস মিয়ার চেয়ে মুক্তির সমাধান খোদা তার পাশে আনবেন কি না, তা বিচার করা উচিত। তবে এই সংঘর্ষে তার মানসিক শক্তি ও প্রত্যয় অনেকগুলি শক্তিশালী অবদান করতে পারে। মানুষের প্রয়াসে কখনও হারা যায় না, তা তার জীবনের উদ্দিপনা হয়ে থাকে।
নিয়াজ মোর্শেদ হিমু
৩য় বর্ষ, প্রাণীবিদ্যা বিভাগ,
রাজশাহী কলেজ।
মুক্তি
10 Must-Read Books by Samaresh Majumdar PDFহ
More Stories
চন্দ্রবোড়া সাপ কামড়ালে কি করা উচিত
সাপ্তাহিক চাকরির খবর ২০২৪
রাসেল ভাইপার কেন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে