শরিফার গল্প বাদঃ কি শিক্ষা পেলাম?
সম্প্রতি সপ্তম শ্রেণীর টেক্সট বই থেকে শরিফার গল্প শীর্ষক বহুল বিতর্কিত অধ্যায়টি বাদ দেয়া হয়েছে। কি শিক্ষা পেলাম? সেই বিষয়ে আলোকপাত করবো।
প্রাচীন কালে এই ভারতীয় উপমহাদেশে বিশেষ করে বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিম অঞ্চল জুড়ে পুন্দ্রবর্ধন নামে একটি রাজ্য ছিল। এই রাজ্যের ব্যাপ্তিকাল ছিল খ্রিস্টপূর্বাব্দ ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে খ্রিস্টাব্দ ষষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত। এই বিপুল সময়ে ওই অঞ্চলের একটি সমৃদ্ধ রাজ্য ছিল। তৎকালীন সময়েও বেশ্যাবৃত্তি ও হিজড়া জনগোষ্ঠীর সামাজিকভাবে হেও প্রতিপন্ন করা হতো। সামাজিকভাবে তারা সবসময়ই নিচুস্তরের মানুষ ছিল। সময় যত অতিবাহিত হয়েছে পৃথিবী আধুনিক হয়েছে, মানুষের সভ্যতা তত মানবিক হয়েছে।
সেই সাথে হিজড়া জনগোষ্ঠীর ব্যক্তি স্বাধীনতা সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশ প্রাচীন হলেও হিজড়া জনগোষ্ঠীর সামাজিক মর্যাদা ও ব্যক্তির স্বাধীনতার ব্যাপারে ইউরোপ আমেরিকা সহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশ অনেক বেশি এগিয়ে গেছে। তারা জনগোষ্ঠীকে সামাজিক মর্যাদা প্রদান করেছে আর দশটি মানুষের মতো তারাও সমাজের একটি অংশ।
উন্নত বিশ্বে তারা এখন আর অমর্যাদাপূর্ণ সামাজিক নিষ্পেষিত অবহেলিত নয়। তারা এখন সাধারণ মানুষের মতোই চাকরি পায়, সামাজিক মর্যাদা পায়। কিন্তু আমরা এখনো এতটা পিছিয়ে কেন? এর কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে দেখা যায় ধর্মভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা আমাদেরকে পেছনে ফেলে দিয়েছে এবং আমরা এই সংকটময় অবস্থা থেকে উত্তরণ করতে পারব না যতদিন না ধর্মভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা আমাদেরকে আধুনিক মানুষ হতে সহায়তা করে।
ধর্মের সংস্কৃতি ও বিধানগুলোই অতি প্রাচীন এবং পুরাতন সমাজ ব্যবস্থার সাথে সঙ্গতি রেখে তৈরি হয়েছিল। যেহেতু ধর্ম গ্রন্থকে আমরা পরিবর্তন করতে পারি না, ধর্মগ্রন্থের বাক্যগুলোকে আমরা বেদবাক্য মনে করি। আধুনিক যুগে যেখানে মানুষের আত্মমর্যাদা সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে সেই অবস্থাতেও আমরা কি পুরাতন সমাজ ব্যবস্থার বিধানগুলোকে আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় কোনভাবে সামঞ্জস্য করতে পারব?
আমার দৃষ্টিতে পুরাতন সমাজ ব্যবস্থা সর্বদাই পরিবর্তনশীল। সময়ের সাথে সাথে সব কিছু পরিবর্তন হয়ে যায় কিন্তু আমরা ধর্মগ্রন্থের চিরস্থায়ী অবিকৃত বাক্য গুলোকে পরিবর্তন করতে পারিনা যার ফলে ধর্মভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় পুরাতন বিধানগুলো জড়িয়ে থাকে।
শরিফার গল্প বাদ দিয়ে কাদের লাভ হল কে পরাজিত হল?
বর্তমানে সপ্তম শ্রেণীর শরীফার গল্প বিষয়ে বাংলাদেশ একটি বহুল প্রচারিত বিতর্কিত ঘটনা ঘটে গিয়েছে। এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে পক্ষে বিপক্ষে বহু মানুষ মতামত দিয়েছে এবং সর্বশেষ জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক ঘোষণায় বলা হয়েছে যে শরিফার গল্প সপ্তম শ্রেণীর বই থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। যারা আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে অবহেলিত নিষ্পেষিত হিজড়া জনগোষ্ঠীকে সামাজিক মর্যাদার একটি ধাপে উন্নত করার চেষ্টা করেছিল তারা আজ পরাজিত হলো।
হিজড়া জনগোষ্ঠী এবং তাদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি নিচুস্তরেই থেকে যাবে। এই ঘোষণার ফলে আগামী প্রজন্মের সন্তানেরা হিজড়া জনগোষ্ঠীর সামাজিক মর্যাদার বিষয়ে সমাজে প্রচলিত কথাগুলোর সাথেই পরিচিত হবে এবং সেভাবেই বাপ-দাদা পূর্বপুরুষদের মনোভাবের সাথে তারাও একই মনোভাব নিয়ে বড় হবে এবং হিজড়া জনগোষ্ঠীকে সমাজের থেকে আলাদা একটি অবহেলিত নিষ্পেষিত শ্রেণী হিসেবেই ভাবতে থাকবে।
নতুন পাঠ্যক্রম ও অনুসারে সপ্তম শ্রেণীতে শরিফার গল্প টিকে আমরা অতিমাত্রায় আলোচনা সমালোচনা করে বিষয়টিকে তিতা করে ফেলেছি। বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে দেখলে এত সমস্যা সৃষ্টি হতো না এতো বিতর্ক থাকত না। আসলে একশ্রেণীর মানুষ রয়েছে সমাজে যারা অতিমাত্রায় সংবেদনশীল ধর্মীয় রীতি-নীতির ব্যাপারে। আমাদেরকে মনে রাখা দরকার, ধর্মের পুরাতন ব্যবস্থা বর্তমান আধুনিক যুগে সর্ব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। একটি উদাহরণ দিলে বোঝা যায়, আপনাকে একটা সময়ে বাড়িতে টেলিভিশন দেখতেও মানা করা হতো কারণ এটা ধর্মীয় বিধানের বিরোধী কিন্তু আপনি এখন প্রতিদিন প্রতিক্ষনে স্মার্ট ডিভাইস ব্যবহার করছেন এবং এটা আপনার বাড়িতে টেলিভিশনের ছোট আকারের উন্নত ভার্সন।
আপনি যেহেতু আপনার স্মার্ট ডিভাইস ব্যবহারের ব্যাপারে কোন ধরনের উদ্বিগ্নতা পোষণ করেন না কারণ আপনি সামাজিকভাবে প্রযুক্তিগতভাবে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলছেন, আপনি পুরাতন সমাজ ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে আধুনিক হওয়ার চেষ্টা করছেন। আমাদের উচিত সমাজের যারা অবহেলিত তাদেরকেও পুরাতন ধ্যান ধারণার বেড়াজাল থেকে বের করে নিয়ে আসা। কিছু ধর্মীয় কিছু সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ভারতীয় উপমহাদেশের হিজড়া জনগোষ্ঠীকে অবহেলিত বঞ্চিত করে রেখেছে। তাই এখনই সময় এসেছে তাদেরকে সমাজের প্রধান ধারার সাথে সম্পৃক্ত করা। জন্মগতভাবে তারা ত্রুটি নিয়ে জন্ম নিয়েছে এটা তাদের নিজেদের কোন দোষ নয়।
আপনি আমি যে কোন সময় পঙ্গুক্ত বরণ করতে পারি । একটি দুর্ঘটনায় আপনার দুটি চোখ নষ্ট হয়ে যেতে পারে আপনার পা দুটি ভেঙে যেতে পারে আমরা সবাই এই ঝুঁকির মধ্য দিয়েই চলি। যেকোনো মুহূর্তে আমরা সমাজের নিষ্পেষিত অবহেলিত জনগোষ্ঠীর শ্রেণীতে পড়ে যেতে পারি। একটি দুর্ঘটনার মাধ্যমে যাকে আমরা বলি ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড অথবা বাংলায় আমরা যাকে প্রতিবন্ধী বলি।
ধর্মভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থাতেও দুর্নীতি বেড়েই চলেছে। ধর্ম আমাদেরকে এই ঊর্ধ্বগতির দুর্নীতি রোধ করতে পারছে না তাহলে কেন অমানবিক আচরণের প্রত্যক্ষ প্রমাণ দেখাবো। বাংলাদেশের হিজড়া জনগোষ্ঠীর ব্যাপারে শুধুমাত্র সন্দেহ মূলক একটি সামাজিক অবক্ষয়ের ভয় দেখিয়ে যার কোন ভিত্তি নেই । আসলে শরিফার গল্প বাদ দিয়েও কোন লাভ হবে কি? সমাজে মানুষের যে মূল্যবোধের অবক্ষয় তা কিভাবে উন্নত হবে? তাই আমাদের উচিত এটা নিয়ে আরো একবার ভেবে দেখা ।
More Stories
চন্দ্রবোড়া সাপ কামড়ালে কি করা উচিত
আবেগ কি আমাদেরকে ব্যক্তিত্ব নির্দেশ করে
মনোযোগ বাড়ানোর কৌশল