লঞ্চ যাত্রা
রাইহান
————————–
বরিশালের সাদেকপুরে নতুন লঞ্চঘাট হওয়াতে আমার জন্য ভালো হয়েছে।বাসা থেকে কাছেই,হেটে যেতে ৩০ মিনিট লাগে।সমস্যা হলো ঠিক মতো রিক্সা পাওয়া যায় না।বড় বোন ঢাকা থাকে তার কাছে যাবো।লঞ্চ ছাড়বে বিকেল ৫ টায়।
আমি ৩ টা বাজে রওনা দিলাম,সাথে একটা স্কুল ব্যাগ তার ভেতর আমার প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র।আর একটা ছোটো ব্যাগে একটা বিছানা চাদর,আর কাথা।কোনো রিক্সা পেলাম না তাই হেঁটে হেঁটে
লঞ্চঘাট পৌঁছাইলাম ৩ঃ৪০ মিনিট এ।
৪ তলা লঞ্চ টা মোটামুটি বড়োই।লঞ্চের স্টাফরা যাত্রীদের কে ডেকে ডেকে লঞ্চে উঠাচ্ছে।টার্মিনাল থেকে লঞ্চে উঠার জন্য একটা সিঁড়ি দেওয়া আছে।সেই সিড়ি দিয়ে ছোটো ছোটো পায়ে এগুচ্ছি,সাঁতার তেমন একটা পারি না,পা পিছলে নদীতে পরলে পানিতে ডুবে যেতে হবে।যদিও আমি গ্রামে বড়ো হয়েছি কিন্তু গ্রামের ছেলেদের কোনো বৈশিষ্ট্য আমার মধ্যে নেই।
গ্রামের ছেলেদের নদীতে সাতার কেটে শৈশব কাটে।উঁচু লম্বা সাঁকো মুক্ত হাতে পার হয়।আর আমি সামান্য লঞ্চের সিড়ি পার হতে হাঁটু কাপাকাপি শুরু হয়ে গেছে।আমার পিছনে যাত্রীদের ঠেলাঠেলি লেগে গেলো।আমি কোনোরকম সিঁড়ি পাড় হয়ে ভেতরে ঢুকলাম।
লঞ্চে ভেতর অনেক জায়গাই খালি পরে আছে,কিন্তু আমি কোথায় বিছানা করবো বুঝতে পারছি না।লঞ্চে খোলা ফ্লোর থাকে,একে ডেক বলে,ডেকে জন প্রতি ভাড়া ২০০ টাকা৷ ডেকের সিস্টেম টা হলো যে যেখানে বিছানা করবে সেই জায়গা তার দখলে।
মজার ব্যাপার হলো জায়গা দখল করার পর সেখানে এমন এক পরিবেশ তৈরি করে যেন ঐ জায়গা এক জীবনে তার অথচ সকাল হলেই সব গুটিয়ে চলে যাবে।আমি কোথাও বিছানা করলাম না।ব্যাগ ২ টা একটা খুঁটির সাথে রেখে দিলাম।ব্যাগে জামাকাপড় ছাড়া তেমন মূল্যবান কিছু নেই,তাই চোরে নিয়ে গেলেও আফসোস নাই।
নতুন লঞ্চ তাই সব ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম।লঞ্চের নিচ তলার পিছনের দিকে অর্ধেক জায়গায় জুড়ে ইঞ্জিন ঘর,বাকি অংশ ডেক।ইঞ্জিন ঘরের চার পাশে লোহার গ্রিলের বেড়া।তার পিছিয়ে রান্না ঘর,আর সর্বশেষে টয়লেট।২য় তলায় সম্পূর্ণ ডেকে যাত্রীদের জায়গা দখল করার জন্য রাখা হয়েছে।৩য় তলায় সব কেবিন (হোটেলের মত রুম) এবং রেস্টুরেন্টে।
৩য় তলার উপরে লঞ্চের সামনের অর্ধেক পর্যন্ত ৪র্থ তলা বাকিটা খোলা ছাদ।৪র্থ তলা মূলত সারেং(লঞ্চের ড্রাইভার )এবং যারা লঞ্চের স্টাফ তাদের জন্য।৪র্থ তলার ছাদের উপর নামাজের জায়গা।
আমার পুরো লঞ্চ টা ঘুরে দেখা শেষ।কিন্তু কেবিন গুলোর ভেতরে দেখতে পারলাম না।এর মধ্যে একটা স্টাফ এসে জিজ্ঞেস করলো স্যার কেবিন লাগবে?তার বয়স ৪০-৪৫ হবে,মুখ ভর্তি করা পান।পান চিবাচ্ছে আর আমার দিকে তাকিয়ে আছে উত্তরের আশায়।
আমি কিছু বললাম না মুচকি হাসলাম,যার অর্থ ধরে নিয়েছে আমার কেবিন লাগবে।সে বললো চলুন আপনাকে কেবিন দেখাই।আমি বললাম আচ্ছা ঠিক আছে চলুন।মনে মনে ভাবলাম এ তো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি।
লোকটা আামকে এক এক করে সব গুলো কেবিন দেখালো। প্রথমে নিয়ে গেলো সিঙ্গেল কেবিনে,ভাড়া ৮০০ টাকা।এই কেবিনে একটা বেড,ছোট্ট একটা ওয়ারড্রব ,ফ্যান,মোবাইল চার্জ দেয়ার ব্যাবস্থা।এর পর নিয়ে গেলো ডাবল কেবিনে ভাড়া ১৪০০ টাকা।
এই কেবিনে শুধুমাত্র একটা বেড বেশি বাকি সব সিঙ্গেল কেবিনএর মতই।তার পর গেলাম স্পেশাল কেবিনে বেড টা বড়, এক সাথে ২ জন ঘুমানো যাবে ভাড়া ১২০০ টাকা। যারা কেবিন নেয় তাদের জন্যে আলাদা ভালো মানের টয়লেট থাকে।
এর পর দেখালো ভি.আই.পি কেবিন,সিঙ্গেল কেবিনের ভাড়া ২০০০ টাকা,ডাবল কেবিন ২৮০০ টাকা।এই কেবিন গুলোকে পাঁচ তারকা হোটেলের সাথে তুলনা করা যায়।এই কেবিনে এসি এবং সংযুক্ত বাথরুম রয়েছে।সব কেবিন দেখানোর পর বললো আপানার কোনটা লাগবে?আমি বললাম একটাও লাগবে না।
সে বললো, তাহলে এতোক্ষণ দেখলেন কেনো?আমি বললাম, আমি তো দেখাতে বলি নাই,আপনি দেখাতে চাইলেন তাই দেখালম। মুরুব্বি মানুষ তা না হলে তো মনে কষ্ট পাবেন।লোকটি বোকার মতো আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।তাকে ধন্যবাদ দিয়ে চলে গেলাম।
লঞ্চ ইতমধ্যে ছেড়ে দিয়েছে।ব্যাকগিয়ার দিয়ে লঞ্চটাকে ঘুরাবে কিন্তু স্রোতের টানে নদীর পাড় ঘেষে পিছনের দিকেই চলতে শুরু করলো।লঞ্চ সারেং এর কন্ট্রোলের বাহিরে চলে গেলো।বুনো হাতি পাগলা হয়ে গেলে যেমন গাছপালা ভেঙে ফেলে লঞ্চ টা তেমনই পাড়ের সুপারি গাছ গুলো ভাঙতে লাগলো।আমি একটু ভয় পেলেও বাকি যাত্রীরা বেশ মজাই পাচ্ছে।
কেউ কেউ আবার অতি বিরক্ত হয়ে সারেংকে গালাগালি করতেছে,কেউ আবার সমালোচনা করতেছে,সারেং নতুন তো তাই এমন হচ্ছে।একসময় সেই অনভিজ্ঞ সারেং লঞ্চটাকে তার কন্ট্রোলে আনতে সক্ষম হয়েছেন।
লঞ্চ তার গন্তব্যে ছুটছে।আমি লঞ্চের একেবারে সামনে চলে গেলাম,হুহু করে বাতাস আমর চুল,জামাকাপড় পিছনের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে।আমি চোখ বন্ধ করে হাত দুটো দুপাশে ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছি,মনে হচ্ছে আমি পাখির মতো আকাশে উড়তেছি। এই লঞ্চটা কে টাইটানিক এর মতো মনে হচ্ছে,আর আমি হলাম নায়ক জ্যাক কিন্তু আমার নেই নায়িকা ক্যাট।তাতে কি কল্পনায় আমি আমার নায়িকা কে নিয়ে আসলাম।
প্রতিটি পুরুষের কল্পনায় তার মনের মতো একটা নায়িকা থাকে,তাকে যখন ইচ্ছে কল্পোনায় আনা যায়।বেশিক্ষন আর আমার নায়ক জ্যাক হয়ে থাকা গেলো না কারণ নাইকা ক্যাটের বদলে নাইকা কাজল চলে আসলো,
-আপনি এখানে কি করছেন?
-এইতো উড়তেছি।
-মানে?
-আপনি কে?
-আমি কাজল,আপনি তো কাকাতারুয়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন,কিভাবে উড়ছেন?
-কিভাবে উড়তেছি তা জানতে হলে আপনাকে ক্যাট হতে হবে। তারপর আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।
-আমি বিড়াল হবো মানে?কি বলছেন আবোলতাবোল?
মেয়েটা মনে হয় রেগে গেছে।
রেগে গেলে মেয়েদের সুন্দর লাগে,এই সৌন্দর্য দেখতে হলে মেয়েদের রাগ কে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে দেখতে হবে।তার রাগ যেনো আপনার মনে কোনো প্রভাব ফেলতে না পারে।
আমার সেই সৌন্দর্য দেখতে ইচ্ছে হলো কিন্তু চোখ খুলতে ইচ্ছে হলো না।অবশেষে আমার চোখ খোলার আগেই মেয়েটা চলে গেলো।এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমার শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে তাই আমিও লঞ্চের ভেতর চলে গেলাম।
মেয়েটাকে খুঁজতেছি,যদি পাই তাহলে আরেকটু রাগিয়ে দেবো।
কিন্তু ভেতরে অনেক গুলোর মেয়ের মাঝে ক্যাট কে কিভাবে শনাক্ত করবো।এক টা কাজ করতে পারি,সব মেয়েদের কাছে গিয়ে নাম জিজ্ঞেস করবো।তাহলে ক্যাট কে পাওয়া যেতে পারে। তবে এটা খুবই বাজে কাজ হবে তাই আমি ছাদে চলে গেলাম একেবারে ৪ তলায়।ওখানে কেউ উঠে নাই,নামাজের জায়গা তাই জুতো খুলে উঠতে হলো।
আমি হাত পা ছড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎপটাং হয়ে শুয়ে আছি৷আকাশটাকে মনে হচ্ছে বিশাল বড় একটা ছাদ,মাঝে মাঝে মেঘের টুকরো উড়ে যায় তখন মেঘের ছায়া পরে,মেঘ চলে গেলে আবার শেষ বিকালের রোদ গায়ে লাগে।
হঠাৎ হৈচৈ শুনে উঠে বসলাম।
জেলেরা নৌকা থেকে আমাদের লঞ্চে ইট পাথর ছুড়তেছে।পরে জানতে পারলাম জেলেদের মাছ ধরা জালের উপর দিয়ে লঞ্চ চলে গেছে,জেলেদের মাছ ধরা জাল ছিড়ে যাওয়াতে তারা ক্ষেপে গিয়ে ইট পাথর ছুঁড়তেছে।সারেং কোন উপায় না দেখে লঞ্চের গতি বাড়িয়ে দিলো।
অনভিজ্ঞ সারেং এর কারণে আজ জেলেদের জাল ছিড়ে গেলো।
আচ্ছা জেলেদের মাছ ধরা জাল কি সবসময়ই এমন কেটে যায়?যার প্রতিবাদ করতে জেলেরা তাদের সাথে ইট,পাথর জমা করে রাখে!হতেও পারে।অনভিজ্ঞ সারেং কে দোষ দিয়ে লাভ নেই।
লঞ্চ নদীর বুক চিরে চলতেছে।
ঢেউ গুলো নদীর পাড়ে সজোরে আঘাত করতেছে।পাড় থেকে মাটির চাকা ওঠে নদীতে আছড়ে পরছে।
নদীর পাড় জুড়ে কাশফুলে সাদা হয়ে আছে।নতুন চরে ধান গাছের চারা চোখ ধাঁধানো সবুজের সমারোহ।
লঞ্চের সাইরেনের শব্দে সেই সবুজের বুক থেকে উড়ে যায় সাদা ধবধবে বকের সারি। মাঝে মাঝে দেখা যায় নদীর পাড় ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট ছোট্ট বাড়ি।
হঠাৎ আমি লক্ষ করলাম,একটা যাত্রীবাহি ট্রলার আমাদের লঞ্চের সামনে দিয়ে আড়াআড়ি ভাবে নদী পাড় হওয়া জন্য দ্রুত গতিতে চালাচ্ছে।আমি খুবই আতঙ্কিত হয়ে গেলাম,কারণ প্রথমত অনভিজ্ঞ সারেং,আর আমাদের লঞ্চ ট্রালারটির অনেক কাছে চলে এসেছে।লঞ্চটি ট্রলার এর উপর উঠিয়ে দিবে এমন অবস্থা।
অবশেষে একটুর জন্য ট্রলারটি বেঁচে গিয়ে জয়ধ্বনি দিতে লাগলো।
৩য় তলার ছাদে ১০ বা ১২ বছরের একটা ছেলে বাদাম বিক্রি করতেছে৷আমি ওকে ডাকালাম,বললাম আমাকে বাদাম দিয়ে যেতে। ও জুতা খুলে আমার কাছে ছাদে উঠে বসলো।ওর হাতে পলিথিনের প্যাকেট করা অনেক গুলো বাদামের প্যাকেট।
কিছু প্যাকেট বড় কিছু প্যাকেট ছোট।ও জিজ্ঞেস করলো,ছোট টা দেবো নাকি বড় টা দেবো?
-কোনটার কি দাম?
-ছোট টা ৫ টাকা,বড় টা ১০ টাকা।
-ও আচ্ছা।তুৃমি যে বাদাম বিক্রি করো,সবাই তোমার বাদাম খাইতেছে কিন্তু তুৃমি কি খেয়েছো?
-নাহ।
আমি ওকে ২০ টাকা দিয়ে বললাম ১০ টাকা দামের ২ টা প্যাকেট দাও।একটা আমি খাবো,আরেকটা তু্মি খাবে৷আমার তেমন বাদাম খাওয়ার অভ্যাস নেই তাই ঠিক মতো খোলস ভাঙ্গতে পারছি না।
কিন্তু ছেলে বেশ চমৎকার করে খোলস থেকে বাদাম বের করে তারপর হাতের তালুতে ঘষা দিয়ে ফু দেয়,বাদামের কালো চামরা গুলো বাতাসে উড়ে যায়,তারপর মুখের ভেতর ছুড়ে মেরে কুট কুট করে খাচ্ছে।আমার কেনো জানি মনে হলো বাদাম খাওয়া একটা শিল্প।আর এই শিল্প,ছেলেটা সবচেয়ে ভালো পারে৷
আমি জিজ্ঞেস করলাম,তোমার নাম কি?
-ফুল মিয়া।
-তো ফুল মিয়া, তুমি আজ কতো টাকার বাদাম বিক্রি করেছো?
-বেশি না, ৫০০-৬০০ টাকা।
-এতে লাভ হবে কতো?
-অর্ধেক অর্ধেক।
-টাকা দিয়ে কি করবা?
-ঘরের বাজার লাগলে করি,না লাগলে জমাইয়া রাখি।
-তোমার বাবা কি করে?
-মাছ ধরে।
-তাহলে তুমি বাদাম বিক্রি করো কেনো?
-বাবা আমার পড়ালেখার খরচ দেয় না,বলে তার লগে মাছ ধরতে।
-তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?
-এবার বৃত্তি পরীক্ষা দিমু৷
-ও আচ্ছা,বড় হয়ে কি হতে চাও?
-অনেক বেশি পড়ালেখা করে বিরাট বড় অফিসার হতে চাই।
-খুব ভালো। মন দিয়ে পড়ালেখা করো,আমার বিশ্বাস তুমি তুৃমি কোনো বড় অফিসার হবে৷
-দোয়া করিয়েন ভাই,আমি এবার যাই।
ফুল মিয়া নেমে চলে গেলো৷আমি তাকিয়ে আছি সূর্যের দিকে। কুসুমের মত সূর্যটা দিগন্ত রেখায় ধীরে ধীরে নদীর ভেতর ডুবে যাচ্ছে,যেখানে আকাশ-নদী মিলিত হয়েছে।অর্ধেক সূর্য নদীর পানিতে তার প্রতিবিম্ব মিলে একটি সম্পুর্ণ সূর্য তৈরি হয়েছে। মনে হচ্ছে অর্ধেক সূর্য আকাশে আর অর্ধেক সূর্য পানিতে।
তবে পানির অর্ধেক টা ঢেউ এর সাথে তাল মিলিয়ে নৃত্য করতেছে।
কিছুক্ষনের মধ্যেই সূর্যের অবশেষে বিলুপ্ত হয়ে গেলো৷আকাশ রঙিন করে নামলো গোধূলি।তুলো তুলো মেঘ গুলো লাল,লালচে কালো,হলুদ,আসমানি আরো কত অদ্ভুত রঙে রঙিন হয়েছে এবং তার প্রতিবিম্ব নদীর পানি লালচে করে দিয়েছে।
সব মিলিয়ে এক অপূর্ব দৃশ্য সৃষ্টি করেছে।লঞ্চে না উঠলে এতো সুন্দর গোধুলি উপভোগ করা যেতো না।গোধুলি নিয়ে একটা কুসংস্কার আছে, তা হলো,হাসান-হোসাইনের রক্ত আকাশে এমন লালা বর্ণ ধারণ করে।এটা ভুল ধারণা।যদি হাসান-হোসাইন এর রক্ত হতো তাহলে কেন শুধু পশ্চিম দিকে লাল বর্ণ ধারণ করে,পূর্ব দিকে কেন নয়?রাতের আাকাশেই বা কেনো কোনো রঙ থাকে না।
এটা প্রকৃত পক্ষে সূর্যের আলোর ৭ রঙের খেলা৷আমরা যে নীল আকাশ দেখি ঐটা মূলত সূর্যের আলোর নীল রঙ ছড়িয়ে আছে,এছাড়া আর কিছুই নেই।আকাশে যে রংধনু দেখি তা সূর্যের আলোর সাত রঙের বিচ্ছুরনের ফল।আপনি চাইলে বাসায় বসেও রংধনু তৈরি করতে পারেন,এর জন্য বেশি কিছুর প্রয়োজন নেই।
একটা বাটিতে পানি ভর্তি করে তার মধ্যে এটা ছোট আয়না কাত করে ডুবিয়ে দিয়ে যেদিক থেকে সূর্যের আলো আসে সেইদিকে রাখতে হবে।এর পর সূর্যের আলো আয়না থেকে প্রতিফলিত হয়ে যেখানে পরবে সেখানে সাদা একটি কাগজ ধরবেন তাহলেই রংধনু দেখতে পাবেন।রংধনু টা সোজা তৈরি হবে যদিও আকাশের রংধনু বাকা দেখা যায়।
আসলে ঔটা বাকা নয়,ভূপৃষ্ঠ সমান্তরালে দূরের কোনো বড় জিনিস কে অর্ধগোলাকার দেখায়।কারন আমাদের পৃথিবীর গোলাকার৷
মাগরিবের আজান দিয়েছে।একদল মুসল্লী নামাজ পড়তে এসেছে,এরা মনে হয় তাবলীগ এর লোক।তাদের সাথে আমিও নমাজ পড়তে দাঁড়িয়েছি।সবাই পশ্চিম দিক করে নামাজে দাড়ালো।কিন্তু নামজের মধ্যেই লঞ্চ ঘুরে পূর্ব দিকে চলতে শুরু করলো।সবসময় নামাজ পড়ি পশ্চিম দিকে আর আজ পড়লাম পূর্ব দিকে।
নামাজ শেষ করে তাবলীগের আমির কে জিজ্ঞেস করলাম,এইযে আমরা পূর্ব দিকে নামাজ পড়লাম,আমাদের কি নামাজ হয়েছে?আমির সাব আমাকে বুঝিয়ে বললেন যে নামাজের শুরুতে পশ্চিম দিক করে দাঁড়ালে হয়,তারপর যেদিকেই যাক সমস্যা নেই।
যাই হোক, আমার নতুন অভিজ্ঞতা হয়ে গেলো।তবে অনেক মুসলিম আছে যারা শুধু পশ্চিম দিকে নায়,উত্তরদিকে,দক্ষিণ দিকে,পূর্বদিকে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ে।
এতে বিস্মিত হওয়ার কারন নেই আমরা কাবাঘরের দিক দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ি।হাজি সাহেবরা কাবাঘর কে কেন্দ্র করে নামাজ পড়ে।আমাদের দেশ থেকে কাবাঘর পশ্চিমে তাই আমারা পশ্চিম দিক ফিরে নামাজ পড়ি।
যাদের দেশ থেকে কাবাঘর পূর্ব দিকে নামাজ পড়বে এটাই স্বাভাবিক।তবে এমন একটা জায়গা আছে যেখানে দাঁড়িয়ে আপনার যেদিক ইচ্ছে সেই দিক নামাজ পড়তে পারবেন।ভেবে বের করুন,খুবই সোজা।
আমির সাহেব কে জিজ্ঞেস করলে কেমন হয়?আমি আমির সহেব কে জিজ্ঞেস করলাম,-হুজুর,একটা জায়গা আছে যেখানে নামাজ পড়ার জন্য কোন দিক নির্ধারণ করার প্রয়োজন নেই,যেদিক খুশি সেই দিকে নামাজ পড়তে পারবেন।সেই জায়গা টা কোথায়?আমির সাব আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন।
লঞ্চের আনাচে কানাচে সবখানে বাতি জ্বলছে।বাতির আলোতে লঞ্চের চারপাশের পানি দেখা যাচ্ছে।কিছু দূর পর পর বড় আকারের টিভি চলতেছে৷সিঁড়ির নিচে তিনকোনা জায়গাটুকু তে দোকান দেয়া হয়েছে।চকলেট থেকে শুরু করে সব কিছুই পাওয়া যায় কিন্তু দাম দ্বিগুণ।আমি এক কাপ চা এবং এক প্যাকেট পটেটো কিনলাম।
চা ১০ টাকা,পটেটো ২০ টাকা৷চা আর পটেটো নিয়ে লঞ্চের এক কোনায় বসে টিভি দেখতেছি আর চা দিয়ে পটেটো খাচ্ছি,গরম ঝাল ঝাল মিষ্টি মিষ্টি অন্য রকম টেস্ট।টিভি তে কি যেনো একটা মুভি চলতেছে।নায়িকার বাবা নায়ক কে বলতেছে,বলো কত টাকা হলে তুমি আমার মেয়ের জীবন থেকে সরে যাবে?নায়ক নায়িকার বাবাকে বলতেছে,চৌধুরী সাহেব,আমি গরীব হতে পারি,কিন্তু আমার ভালোবাসা গরীব না।
কিন্তু টিভির দিকে কারো মন নেই।যে যার যার মতো বসে আছে,শুয়ে আছে। সবাই মোবাইল নিয়ে ব্যাস্ত,কানে হেড ফোন দিয়ে গান শুনছে। সুন্দরী মেয়েদের দিকে ছেলেরা তাকিয়ে আছে।একটা মেয়ে দেয়াল সাথে হেলান দিয়ে হাটু ভাজ করে বসে আছে।মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আমি হতভম্ব হয়ে গেছি।মেয়েটার কি কোনো শরম লজ্জা কিছুই নেই?
যতই খারাপ মেয়ে হোক,সবার মাঝে নেঙ্গটো হয়ে বসে থাকবে!পরে বুঝতে পারলাম মেয়েটা নেঙ্গটো নয়,স্কিন কালার টাইট পড়েছে।তাই মনে হচ্ছে কিছু পড়ে নেই।তবে যা পড়েছে ওটা পড়া আর না পড়া এক কথা।
লঞ্চের ভেতর যাত্রীরা তাদের সংসার ভালোই গুছিয়েছে।কাথা,বালিশ সব কিছুই আছে,সাথে করে রাতের খাবার রান্না করে নিয়ে এসেছে৷খুঁটির সাথে দেশি মুরগী বাধা,গ্রাম থেকে টাটকা শাক সবজি,লাউ,কুমরা, নারিকেল আরো অনেক কিছু সাথে করে নিয়ে এসেছে।যদিও ঢাকা তে টাকা হলে সব ই পাওয়া যায়।
লঞ্চের ভেতর থাকলে মনে হয় লঞ্চ স্থির।কোন দিকে চলছে,লঞ্চ মাটিতে নাকি পানিতে তাও বুঝা যায় না।আমি চলে গেলাম ৩য় তলায়।প্রতিটা কেবিনের সামনে একটা টেবিল এবং ২ টা চেয়ার রয়েছে।আমি একটা চেয়ারে বসলাম।পানির দিকে তাকিয়ে আছি৷নদীর পানি লঞ্চের পাশ দিয়ে ছিটকিয়ে পড়ছে।হঠাৎ কেবিনের দরজা খুলে একটি মেয়ে বের হলো।
মেয়েটি খুব সুন্দর,চিকন,মাথার চুল রং করা,ঠোঁটে লাল লিপস্টিক,জিনস প্যান্ট আর নীল টপস পড়া৷আমাকে দেখে বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো,আপনি এখানে কি করছেন?কণ্ঠ শুনে বুঝতে পারলাম এই মেয়েটাই ক্যাট।আমি বললাম
-আপনিই তো সেই ক্যাট,তাই না?
মেয়েটি রেগে গিয়ে বললো,
-আমি কাজল।আপনি বার বার আমাকে বিড়াল বলছেন কেনো?
-এমনেই মজা করে বললাম।
-এখানে একা একা বসে আছেন কেন?
-আমি একা তাই।
ক্যাট আমার সামনের টেবিলে বসলো,তারপর জিজ্ঞেস করলো আপনার সাথে আর কেউ আসে নাই।
-নাহ, আমি একাই৷
-ও আচ্ছা। আমরা ঢাকা থেকে ছোটো মামার বিয়েতে আসছিলাম। এখন ব্যাক করতেছি।আপনি যাচ্ছেন কোথায়?
-এটা ঠিক বলা যাচ্ছে না,লঞ্চের সারেং অনভিজ্ঞ।দেখা গেলো পথ ভুল করে বঙ্গোপসাগরে নিয়ে গেলো।
-ও মাই গড। তারপর কি হবে?
-তার পর বঙ্গোপসাগর থেকে আটলান্টিক মহাসাগরের চলে যাবে,ওখানে বরফের পাহাড়ের সাথে লঞ্চ ধাক্কা লেগে ডুবে যাবে।তার পর আপনি আর আমি একটা ভেলা ধরে ভেসে
থাকবো।আপনি থাকবেন ভেলার উপরে,আমি থাকবো পানিতে গলা পর্যন্ত ডুবে,আপনি আমার হাত ধরে রাখবেন।মেয়েটি অত্যন্ত রেগে গিয়ে বললো,
-হোয়াট ননসেন্স!আপনার মাথায় প্রোবলেম আছে।ভালো এক জন সাইকোলজিস্ট দেখান।
মেয়েটি উঠে কেবিনে চলে গেলো।
ভাত খেতে হবে,রেস্টুরেন্টে গেলাম।রেস্টুরেন্টে ঢুকে মনে হচ্ছে না আমি কোনো লঞ্চে আছি।রেস্টুরেন্টে সব কিছুই পাওয়া যায়। আমি ভাত,ভাজি,আর তেলাপিয়া মাছ নিলাম।রান্না বেশ ভালো তাই তৃপ্তি করে খেলাম।আমার বিল হলো ৮০ টাকা।রেস্টুরেন্ট থেকে বের হলাম।
পটেটো দিয়ে চা খাওয়া ঠিক হয় নাই।পেটের মধ্যে কেমন যেনো করতেছে।বাথরুমে যেতে হবে।কিন্তু বাথরুমের কাছে গিয়ে দেখি বিশাল বড় লাইন।কিছুক্ষন লাইনে দাঁড়িয়ে মনে হলো ১ ঘন্টার আগে কিছু হবে না।আমি লাইন ছেড়ে ৩য় তলায় কেবিনের জন্য যে বাথরুম আছে ওখানে ঢুকে গেলাম।
ডেকে কয়েক টা জায়গায় তাস খেলার আসর জমেছে।সেই তাস খেলা দেখার দর্শক ও কম নেই।আমিও দাড়িয়ে খেলা দেখতলাম৷
রাত ১২ তার মতো।সবাই বাতি বন্ধ করে শুয়ে পরেছে৷আমি চলে গেলাম সেই অনভিজ্ঞ সারেং এর রুমে।
-স্যার ভেতরে আসবো?
-আসেন।
-আপনি সারারাত ধরে লঞ্চ চলান ঘুম আসে না?
-নাহ,এটাই তো আমার কাজ।তাছাড়া আমি দিনে ঘুমাই।
-ওহ,আচ্ছা যদি কখনো পথ ভুল করেন তাহলে কি হবে?
-পথ ভুল করবো কেনো?১০ বছর ধরে লঞ্চ চালাই।পানি দেখে নদীর নাম বলে দিতে পারি৷
আমি ছাদে চলে গেলাম।পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে।চাঁদের আলোতে চারপাশ রোমাঞ্চকর পরিবেশ তৈরি হয়েছে।আমি চিত হয়ে শুয়ে চাঁদ দেখতেছি৷চাঁদের আলো আমার শরীরে বৃষ্টির মত ঝরতেছে৷এভাবে কখনো চাঁদ দেখা হয় নাই।চাঁদ টা আমার সাথে সাথে চলতেছে।
আমাদের লঞ্চকে পিছনে ফেলে আরো অনেক গুলো লঞ্চ চলে যাচ্ছে।লঞ্চ গুলো আমাদের লঞ্চের প্রায় দ্বিগুন।এগুল বরিশাল লঞ্চ ঘাট থেকে ছেড়ে এসেছে।নদীতে প্রচুর ঢেউ।আমাদের লঞ্চ নৌকার মতো দুলতেচে।এটা মনে হয় পদ্মা নদী।চাঁদ পুরের কাছাকাছি চলে এসেছি।নদীর তীরে সারি সারি বাতি জ্বালছে।
এগুলো প্রকৃতপক্ষে নদীর পাড়ে সারিবদ্ধ নয়,অনেক দুরে দুরে অবস্থিত।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম বুঝতে পারছি না।প্রায় সকাল হয়ে গেছে। সদরঘাট দেখা যাচ্ছে,ঘাটে সারিবদ্ধ হয়ে লঞ্চ গুলো দাড়িয়ে আছে।এরা অনেক আগেই চলে এসেছে৷লঞ্চ ঘাট করবে,সবাই নামার জন্য প্রস্তুত।কার আগে কে নামবে এমন একটা প্রতিযোগিতার জন্য দাড়িয়ে আছে।লঞ্চ ঘাট করার সাথে সাথে
সবাই স্রোতের মতো নেমে পড়বে।
আমি ব্যাগ ২ টা নিলাম।টিকেট কাটা হয় নাই।টিকেট কাটতে গেলাম মতো এক লোক বললো তোমার টিকেট কাটা লাগবে না,আমার সাথে চল,আমি পার করে দেবো,আমাকে ১০০ টাকা দিলেই হবে।আমি ভাবলাম সে যদি ১০০ টাকায় পার করতে পারে তাহলে আমার তো কোনো সমস্যা নেই,আরো ১০০ টাকা বেচে যাবে।
আমি বললাম,আচ্ছা ঠিক আছে।লোক টা আমাকে ৩য় তলায় ছাদের উপর নিয়ে গেলো।তারপর আমার ব্যাগ ২ টা নিয়ে পাশের একটা লঞ্চে লাফ দিলো।পাশের লঞ্চটা প্রায় ৫-৬ ফুট দুরত্বে।লোকটা আমাকে বলতেছে লাফ দিয়ে ঔ লঞ্চে যেতে।আমার বুক ধড়ফড় করা শুরু হয়ে গেলো।কারণ আমার জীবনে কখনো এমন লাফ দেয়ার অভিজ্ঞতা নেই।
ঠিক মতো লাফ দিতে না পারলে বুড়িগঙ্গার পানি খেয়ে মরতে হবে।আমার পিছনে থেকে কে যেনো বলতেছে,ধর ধর,পালাচ্ছে।আমি কোনো কিছু না ভেবে এক লাফ দিলাম। লোকটি আমার হাত না ধরলে হয়তো পানিতে পড়ে যেতাম।
আম তাকে ১০০ টাকার একটা নোট দিয়ে লঞ্চ থেকে নেমে লঞ্চের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।আমার শরীর শীতল হয়ে আসতেছে।
লঞ্চ যাত্রা
রাইহান
১ম বর্ষ,ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রকাশিত: বর্ণালী মাসিক ম্যাগাজিন (১ম সংখ্যা)
More Stories
চন্দ্রবোড়া সাপ কামড়ালে কি করা উচিত
সাপ্তাহিক চাকরির খবর ২০২৪
রাসেল ভাইপার কেন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে