২৬ মার্চের ভোরবেলা থেকেই কুমিল্লা তে গণহত্যা শুরু হয়েছিল কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের পাক সেনাদের দ্বারা। কুমিল্লার ময়না মতি ক্যান্টনমেন্ট কুমিল্লা শহর থেকে ৩ কিমি দুর পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত যেখানে পাক সেনারাই বেশি। বাঙালি সেনা সংখ্যা কম। অস্ত্রের মুখে তাদের কে বাইরে এনে সারি বদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর পর তারা শহরের দিকে যায়। মার্চ এর ২৬ সারা দিন শহরের হিন্দু অধ্যুষিত আবাসিক এলাকা দোকান পাঠ রাস্তা ঘাট তল্লাশি চালান হয়। একদন সেনা ট্রাক রেল স্টেশন এর দিকে যায় সেখানে শতাধিক বাঙালি ট্রেন এর জন্য অপেক্ষা করছিল তাদের কে মেশিনগানের গুলিতে হত্যা করা হয়। পাক সেনা রা মার্কেট আক্রমণ করে দোকান লুট, বাড়ি অগ্নি সংযোগ দোকান এ আগুন, দোকানিকে হত্যা করে। যে সব বাড়িতে মিলিটারি সরকারের প্রতিবাদ সরূপ কালো পতাকা লাগান থাকতো সেসব বাড়ি অতি দ্রুত আগুনে প্রজ্বলন করা হত। কার্ফু জারি করা হয়েছে। সারা দিন এই গণহত্যা চলেছে সারা শহরে। তারপর তারা কান্ত কিন্তু তুষ্ট মৃত্যুর খেলা খেলে, এরপর তারা ব্যারাকে ফিরে গিয়েছে। পৌর ময়লার ট্রাক বের হয়ে মৃত দেহগুলোকে সংগ্রহ করে শহরের সার্কিট হাউস এর পিছনে গন কবর দেয়। মৃতের প্রকৃত সংখ্যা জানা যায় না কিন্তু এক হাজার এর কম নয়। কোন ভাবে কয়েক হাজার মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়।
যেহেতু কার্ফু জারি করা হয়েছিল এবং টহলরত সেনারা দেখ মাত্র গুলি করে হত্যা করছিল তাই মানুষ ঘর থেকে বাইরে বের হতে পারেনি।
২৬-২৭ মার্চ রাতে পূর্ব বাংলার নেতা ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত কে তার বাড়িতে আক্রমণ করা হয়।
সৈন্যরা তার ছেলেকে ও তাঁকে টেনে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে যায়। মি দত্তর নাতি, যিনি রান্না ঘরে আশ্রয় নিয়েছিল এবং পরে থাকে ঘরের মেঝে তে রক্ত সহ পাওয়া যায়। ১৫ দিন পরে জানা যায় যে খুব নির্যাতন করার পর ক্যান্টনমেন্ট এ মি দত্ত কে হত্যা করা হয়। তার ছেলের নিরুদ্ধেশ। [নোট: ধীরেনড্র নাথ দত্ত ছিলেন অবিভক্ত পাকিস্থান এর নেতা এবং পূর্ব পাকিস্তানে পার্লামেন্টের সদস্য । তিনি প্রথম প্রস্তাব উত্থাপন করেন যে বাংলা হবে পূর্ব পাকিস্থানের রাষ্ট্র ভাষা।]
দৈনিক মর্নিং নিউজ, করাচী পত্রিকার সহকারী সম্পাদক আন্টনি মাস্কারেনহাস, যিনি ছিলেন ৮ জনের মধ্যে একজন সাংবাদিক যাকে পাক মিলিটারিরা একটা ট্যুরে তাঁকে সাথে নিয়েছিলেন মানুষ কে জানাতে যে পাক বাহিনীরা খুব ভাল কাজ করছে সেখানে। কিন্তু কুমিল্লা তে গিয়ে তিনি যা নিজ চোখে দেখলেন তাতে তিনি আর বিবেকের কাছে সায় দিতে পারলেন না পাকিদের এই বিভিশকাময় অত্যাচার দেখে। পাকিদের ৯ম ডিভিশনের সাথে ৬ দিন বেড়ানোর পর তিনি কাছ থেকে দেখলেন এই হত্যা যজ্ঞ।
তিনি দেখলেন যে হিন্দুদের গ্রাম থেকে গ্রামে ঘর থেকে ঘরে তল্লাশি করে খুজে খুজে হত্যা করা হচ্ছে।
কুমিল্লা সার্কিট হাউস এ তিনি শুনতে পেলেন মানুষের চিৎকার বন্দুকের ও অস্ত্রের আঘাতে নির্যাতন করার দৃশ্য। নির্যাতনের এই চিৎকার শুনে ৯ম ডিভিশন এর সেনাদের মধ্যে উল্লাস দেখা গিয়েছে বিশেষ করে লে কর্নেল আসলাম বেগ ও মেজর বশির (SOS)। তিনি আরো দেখলেন ট্রাক বোঝাই মানুষের লাশ। জুনে Sunday times পত্রিকায় লেখেন যে, এটা বিশ্বাস করা সত্যি কঠিন যে একটা অপ্রাকৃত সৌন্দর্যের মাঝে নির্মম পাশবিকতা ও নিষ্ঠুরতা। কুমিল্লা গাছে ফুল ফুটতে শুরু করেছে যখন আমি এপ্রিল মাসে সেখানে পৌছাই। বিশ্বের মধ্যে কুমিল্লা হল অধিক ঘনত্বের শহর যেখানে ১৯০০ প্রতি বর্গ কিমি তে মানুষ বাস করে। এমন কোন জায়গা নাই যেখানে মানুষ দেখা যায় না।
কিছু দিন আগেই আমি আমার সহকর্মীদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম বাঙ্গালিরা কথায়? ‘তারা গ্রামে চলে গেছে’ জানালেন একজন পাক সেনা। আর এখন গ্রামেও কোন মানুষ নাই। ঢাকার মত কুমিল্লা শহর কেও অতি মাত্রায় হত্যা কাণ্ড ঘটান হয়েছে। কিন্তু ১০ মাইল দুরে লাকসামের কোন এক রাস্তায় কৃষক কে আমি দেখেছি গুটি কয়েক জন তাও দুই হাতের আঙ্গুল দিয়ে গুণে গুণে বলা যাবে। সেখানে অবশ্যই পাক সেনা দের দেখাতে পাবেন মুখে হাসিহীন, খাকি পোষাকে হাতে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল। তাদের হাত থেকে রাইফেল কখনও নামানোর আদেশ নাই। রাস্তা গুলোতে অবিরত টহলরত পাক সেনারা । যেখানে পাক সেনা সেখানে বাঙালি খুঁজে পাবেন না । যেহেতু মাত্র ৯ কিমি দুরে সীমান্ত তাই সমস্ত কুমিল্লা শহরে শাস্তি ও হত্যা যজ্ঞ চলেছে পুরা ৮ এপ্রিল মাস পর্যন্ত।
এভাবে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের ৯ম ডিভিশন সেনারা তাণ্ডব চালাতে চালাতে ব্যারাকে ফিরে যায়। নদীর স্রোতের মত দলে দলে মানুষ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা সীমান্ত দিয়ে যে, যে যেভাবে পারছে আশ্রয় নিচ্ছে। বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে মে মাসে পর্যন্ত ২ লক্ষ শরণার্থী ভারতের ত্রিপুরা আশ্রয় নিয়েছে। বহু মানুষ পথে মারা গিয়েছে না খেয়ে মরেছে রাস্তার ওপর পড়ে আছে।
ময়লা অভুক্ত অর্ধ উলঙ্গ চলমান মানুষের সারি সারি লাইন দেখলে বোঝা যায় যে কত হৃদয় বিদারক তাদের এই বাসভূমি ত্যাগের যাত্রা যারা এসেছিল কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম থেকে যেতে হবে ৬০ কিমি দুরে সীমান্তে নিরাপদ স্থানে।
নারী পুরুষ ছেলেমেয়ে তাদের সব সহায়সম্বল নিয়ে চলেছে কখনও থেমে, কখনও ছিন্ন করে শরীরের অর্ধ নগ্ন অবস্থা, দড়ি পেছানো তাদের পুটলি এ যেন যেকোনো ভাবে নিজের জীবনটা বাঁচাতে হবে।গর্ভবতী নারীরা তাদের পেটের বাচ্চা ফেলে নিজের জীবন বাঁচিয়েছে। কত শরণার্থী মারা গিয়েছে এখনও জানা যায়নি। তবে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকারের সাহায্য কমিটির গণনায় জানা যায় যে প্রথম ৭ দিনেই এ সংখ্যা ১ লক্ষ ৫০ হাজার এ দাঁড়ায়।
একজন শরণার্থীর কথা আমরা জানি যে কিনা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মৌন, মাত্র এক থালা নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ৭৫ মাইল পাড়ি দিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। সে তার নিজের সন্তানকে নিজের খাবারের ভাগ দেয়নি ফলে মৃত্যুবরণ করেছে শিশুটি । তার কন্যা কে স্বামী সহ পাকিরা তূলে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করেছে।সে তাসর ৯ মাসের ছেলে সন্তান নিয়ে পলায়ন করেছিল যখন পাকিরা গ্রামে তাদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়।
নদীর স্রোতের মত শরণার্থীরা দলে দলে আসছে এবং শত শত পথেই মারা গেছে। নিজের মৃত পরিজনদের ফেলে মায়া ত্যাগ করে আবার সীমান্তের উদ্দেশ্যে ছুটে চলা। শরণার্থীদের মধ্যে প্রথমে শিশুরা মারা যায়, তারপর পথে যেতে যেতে বৃদ্ধ ও ছেলেমায়েরা মারা যায় এবং সব শেষে নারীরা। আগরতলা থেকে সীমান্ত পর্যন্ত শরণার্থীদের এত গাদা গাদি ও নিদারুণ অবস্থা যে জনবহুল শরণার্থী ক্যাম্প এর মত। তাদের চোখে মুখে হতাশার চিহ্ন। বাঙালিরা নভেম্বর মাস পর্যন্ত উত্তর মুখে চলেছিল খালি পায়ে একটু খাবার ও থাকার জায়গা পাবার জন্য। ভারতে স্কুল ও সরকারি অফিস গুলোকে বৃহৎ থাকার জায়গা করে দেয়া হয়েছিল কিন্তু জায়গা ছিল খুব কম এবং অধিকাংশ পরিবারকে খোলা জায়গা থাকে হয়েছিল।
রফিকুল ইসলাম একজন রেল কর্মকর্তা ছিলেন তাদের মধ্যে একজন। তার ডান পা এবং বাম হাত প্লাস্টার করা।সে বলল যে, এপ্রিল মাসের ১০ তারিখে পাক হানাদাররা তাদের গ্রামে প্রবেশ করে এবং যুবক ও সমর্থ ব্যক্তিদের আখাউরার কাছে একটি ক্যাম্পে নিয়ে যায় এবং জিজ্ঞাসা করে যে, তারা বাঙালি কিনা তারপর তাদের মাটিতে শুতে বলে।তারপর সেনারা তাদের চারিদিকে ঘুরে ঘুরে গুলি করে। একটি বুলেট তার হাতে লাগে এবং সে শুয়েই থাকে তারপর চলে যাবার সময় তার পায়ে বন্দুকের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে রেখে যায়। তার পর রফিকুল বলে যে সে এবং আরও তিন জন আহত অবস্থায় পালিয়ে এসেছিল। তারপর ঘটনা ক্রমে তারা এখন ইন্ডিয়াতে চিকিৎসার জন্য এসেছে।

এমন প্রমান ও পাওয়া যায় যে যখন শরণার্থীরা নৌকায় করে ফেনী নদী পার হবার চেষ্টা করছিল তারা গুলি করে হত্যা করার চেষ্টা করে।
সেইসময়ে যারা নির্যাতিতা ছিলেন তাদের প্রত্যক্ষ বর্ণনা যদি লেখা হয় তবে হাজার পৃষ্ঠা লেগে যাবে সেই বিভীষিকা ময় ঘটনার কথা তূলে ধরতে। সীমান্ত শহর আগরতলা ২৬৭ বেড জেনারেল হাসপাতালের একজন সুপারভাইজার ডক্টর রথিন দত্ত বলেন যে এ হাসপাতাল সর্বদা ব্যাস্ত অতিরিক্ত আহত শরণার্থীদের সেবায় জায়গা ও কম।
মুসলিম লীগ জামাত ইসলাম এবং নিজামী ইসলাম এই সব দলের থেকে সদস্য নিয়ে কমপক্ষে ৬৭টি শান্তি কমিটি গঠিত হয় মিলিটারি কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে এবং এই সদস্যের সংখ্যা ৫০ হাজার হয়ে যায। এভাবে একটি শক্তিশালী রাজাকার বাহিনী গঠিত হয় সেই সময়ে এই রাজাকার বাহিনী খুব কাছ থেকে আর্মিদের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাহায্য করত।
আর্মিরা নন বাঙালি মুসলিম বিশেষ করে বিহারী এদেরকে বিশ্বাস করতো সেই সময়ের বিভিন্ন কাজের রাজাকাররা আর্মিদের তথ্য দিত।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনীর দ্বিতীয় পর্যায়ের মিলিটারি অপারেশনের সময়ে রাজাকাররা আর্মিদের কে সুন্দরী মেয়েদের ধরে নিয়ে এসে দিয়ে আসতো রাজাকারেরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য লুট করতো হিন্দুদের হত্যা করত সন্দেহভাজন বিদ্রোহী মুক্তিসেনাদের এবং স্থানীয় ভাবে সহিংসতা সৃষ্টি করা রাজাকারদের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব ছিল এভাবে তারা মিলিটারি কর্তৃপক্ষকে পূর্ব পাকিস্তানকে নির্মূল করতে সাহায্য করতো।
ঢাকা এবং কুমিল্লা অঞ্চলের উচ্চ পর্যায়ের মিলিটারি অফিসার সাংবাদিক মাসকারেনহাস কে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে বলেছিলেন যে পূর্ব পাকিস্তানকে পরিষ্কার করতে আমরা সংকল্পবদ্ধ, এটা যদি দুই লক্ষ মানুষের হত্যার বিনিময় হোক অথবা ৩০ বছর ধরে উপনিবেশ এর মতো করে শাসন করে হোক না কেন? ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ তারিখে যখন জেনারেল টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে লেফটেনেন্ট জেনারেল অ্যাডমিরাল আসেন এবং শাহজাদা খানের কাছ থেকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন তখনই তিনি পূর্ব পাকিস্তানের এই পরিষ্কারকরণ অপারেশন এর পরিকল্পনা করেছিলেন যা কিনা ক্লিনজিং অপারেশন (কুমিল্লা) নামে পরিচিত। মিস্টার এ আর এস দোহা একজন পশ্চিম পাকিস্তানের উচ্চ পর্যায়ের আওয়ামী লীগের নেতা এবং রাওয়ালপিন্ডি জাতীয় সম্মেলনের মনোনীত প্রার্থী ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং ঢাকা কে বলেন যে ইয়াহিয়া খান মার্চের ২৫ তারিখ প্লান করেছিল মিস্টার দোহা কে গ্রেফতার করা হয় হাজার ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের পরপরই যখন তিনি রাওয়ালপিন্ডি আসেন মার্চের ২৬ তারিখ ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তিনি রাওয়ালপিন্ডি জেলে ছিলেন এবং এপ্রিলের কোন এক সময় পর্যন্ত তিনি রাওয়ালপিন্ডি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে সমর্থ হন। তার বিবৃতি, ইয়াহিয়ার প্লান সম্পর্কে, যা কিনা সামরিক আইন কে আরো বেশি শক্তিশালী করে পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারে এবং তিনি বলেন যে পূর্ব পাকিস্তানের এই পরিকল্পনা ২৫ মার্চের মিলিটারি অপারেশনের অনেক আগেই নেয়া হয়েছিল তিনি বলেন ১৯৬৯ সালের ১৮ অক্টোবর তারিখে।
অনুবাদঃ Public Property of book, Genocide of Bangladesh, Author: Kalyan Chaudhuri, Sept 1972, India
More Stories
গবেষণা কি উৎসাহ নাই দেশে
Correction of Gravity Measurements: Bouguer Correction-Latitude Correction-Terrain Corrections-Free-Air Correction
স্মার্টফোন ও কম্পিউটার আসক্তি আপনার ক্ষতি করছে না তো?