আধুনিক কালে ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীতকে বিশৃঙ্খলার পংকোদ্বার হতে উদ্ধার করার জন্য ভারতবর্ষে ২জন মহাপুরুষ এর আবির্ভাব ঘটেছিল।তাদের মধ্যে একজন হলেন পণ্ডিত বিষ্ণু নারায়ণ ভাতখন্ডে।১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের ১০ই আগষ্ট বোম্বাই এর বালেশ্বর নামক স্থানে তাঁর জন্ম হয়।ছোটবেলা থেকেই তিনি মায়ের নিকট ভজন গান আর কাশীর বিখ্যাত বমন দাস এর নিকট সেতার শিখেছিলেন।যদিও বাল্যকালে তার অবহেলা ছিল না লেখাপড়ায়।১৮৮৩ খিস্টাব্দে তিনি তাঁর মেধাশক্তি দিয়ে বি এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে এল এল বি পাশ করেন।স্বভাবতই ছোটবেলা থেকে সঙ্গীতের প্রতি ছিল তাঁর গভীর অনুরাগ, আর সেকারণেই ব্যারিস্টারি পেশায় না এসে তিনি সঙ্গীতের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সঙ্গীত সাধনায় মনোনিবেশ করেন।তখন থেকে তিনি তৎকালীন প্রসিদ্ধ ধ্রুপদীয়া জাকিরুদ্দিনের নিকট বহু ধ্রুপাদ গান আর আসেখ আলী ও মুহম্মদ আলীর নিকট বহু খেয়াল শিখে আলোড়ন সৃষ্টি করে ফেলেছিলেন ভারতবর্ষে। যে কোনো গান শোনা মাত্র তিনি তা নিজের আয়ত্ত্ব করে ফেলতে পারতেন বলে,গুণী সমাজ তাঁকে “চতুর” বলে সম্বোধন করতেন।
১৯০৪ খ্রিস্টাব্দেই পণ্ডিতজীর ঐতিহাসিক সঙ্গীত যাত্রা শুরু হয়।আর তখনকার উচ্চাঙ্গ সংগীত এর নানারূপ বিশৃঙ্খলা আর এর অন্তিম অবস্থা দেখে তাঁর মন বিচলিত হয়ে ওঠে, তা প্রতিরক্ষার জন্য তিনি উদ্গ্রীব হয়ে পড়েন।তিনি নিজ চেষ্টায় নিজ অর্থ ব্যয়ে লাঞ্ছনা স্বীকার করে অনেক প্রদেশ, রাজ্য ঘুরে প্রাচীন সঙ্গীত সাহিত্য খুঁজে তাঁর উদ্ধার এর প্রয়াস চালান।এটা করেই ক্ষান্ত হন নি,
তিনি নিজে নিজে বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞের দুয়ারে ঘুরে নিজে তাদের নিকট হতে সঙ্গীত শুনে, শিখে হিন্দুস্তানী সঙ্গীত পদ্ধতিতে তার স্বরলিপি করে “ক্রমিক পুস্তক মালিকা” নামে ৬টি খন্ডে বিভক্ত করেন যা ভারতীয় সসঙ্গীত জগতে অমূল্য দান বলে স্বীকৃত। এছাড়া তিনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের উপর মারাঠি ভাষায় ৪ খন্ডে বিভক্ত “সঙ্গীত পদ্ধতি” রচনা করেন এবং সংস্কৃত ভাষায় “অভিনব রাগ মঞ্জুরী” আর “লক্ষ সঙ্গীত” নামে ২ খানা গ্রন্থ প্রকাশ করেন।
শাস্ত্রীয় বা উচ্চাঙ্গ সংগীত এর উন্নতিকল্পে তিনি ঠাট বিলাবলকে শুদ্ধ মেনে রাগ পদ্ধতি স্বীকার পূর্বক সে রাগ গুলোকে ঠাট অনুযায়ী ১০ টি ভাগে ভাগ করেন।বিলাবল,ইমন,খাম্বাজ, কাফি,ভৈরব,ভৈরবী, আশাবরী, পূরবী, তোড়ি।
তারপর তিনি এই রাগ রাগিণী সম্বন্ধে মতভেদ এর সমাধান এবং তাঁর সুষ্ঠু ও যথাযথ প্রচারকার্যে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে, সসর্বপ্রথম বরোদায় এক মহান সঙ্গীত সম্মেলন এর আয়োজন করেন যা উদ্ভোদন করেন সেখানকার মহারাজা স্বয়ং। আর সেই সম্মেলনে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত এর প্রসারকল্পে শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতজ্ঞ আর গণ ভারতের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সম্বন্ধে বিশদ আলোচনা বক্তৃতা হয় আলোচনা শেষে সর্বসম্মতিক্রমে “অল ইন্ডিয়া মিউজিক একাডেমী” নামে আর বরোদা সঙ্গীত মহাবিদ্যালয় নামে সঙ্গীত মহাবিদ্যালয় স্থাপন এর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেন।তাঁর সম্মেলন এর এই মহামূল্যবান ভাষণ গুলো ইংরেজিতে “এ শর্ট হিস্টোরিক্যাল সার্ভে অফ্ দি মিউজিক অফ্ আপার ইন্ডিয়া” নামক পুস্তক আকারে প্রকাশিত করা হয়েছিল। এভাবে তিনি দিল্লী,লখ্নৌ, বেনারস প্রভৃতি স্থানে সঙ্গীত সম্মেলন করেন।সঙ্গীতের যথোচিত প্রচারকল্পে তিনি লখ্নৌতে “লখ্নৌ মরিস মিউজিক কলেজ” এবং গোয়ালিয়রে “মাধব সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়” স্থাপন করেন। পরবর্তীতে তাঁর মৃত্যুর পর পুণ্য স্মৃতি রক্ষার্থে তাঁর নামের অনুকরণে “লখ্নৌ মরিস মিউজিক কলেজ” নাম পরিবর্তন করে “ভাতখন্ডে সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়” নামকরণ করা হয়।
পন্ডিতজী অক্লান্ত পরিশ্রম আর নিজ প্রচেষ্টায় ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের মহান সেবা দিয়ে গেছেন।অবশেষে ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে সেপ্টেম্বর তিনি ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত জগত ও পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন।
ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীত আর শাস্ত্রীয় সঙ্গীত জগতে এই মহাপুরুষ তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টার ফলে তাঁর মৃত্যুর পর ও উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে আছেন,যার অনস্বীকার্য অবদাম বিশ্ব ব্যাপী বিস্তৃত এখন। ইতিহাসে ভাতখন্ডের যে অবদান ছিল তা তাঁর মহাপ্রস্থান এর পরেও নিষ্প্রভ উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত এর জগতে এক নব যুগের সৃষ্টি করে নতুন প্রাণের সঞ্চার তৈরী হয়েছিল। ইতিহাস এখনও তাঁকে আর তাঁর এই চির অম্লান অবদানকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।
More Stories
Ascension Day Countdown: 55 Groups Celebrates worldwide
Bangladesh Genocide became the most heinous crime by Pakistani Army in 1971 documented by World Record
প্লেগ রোগের উৎপত্তি কোথায়: মহামারী সংকলন-1