হাইপোথিসিস এর গুরুত্ব
হাইপোথিসিস্-এর গুরুত্ব যুক্তি বিচার ও বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে এতই গুরুত্বপূর্ণ যে হাইপোথিসিসের পর্যায়কে বাদ দিলে পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে সমস্ত রকম সতর্কতা ও নিষ্ঠা সত্ত্বেও তার পরিণতি হাস্যকর হয়ে উঠতে পারে। বিষয়টা পরিষ্কার করতে একটা উদাহরণ হাজির করতে পারি ।
হাইপোথিসিস এর গুরুত্ব বোঝাতে গল্প
“মনে করুন, কোন এক ‘ক’ মশায়ের হঠাৎ মনে হল যে তাঁর পাশের ফাঁকা চেয়ারটিতে একজন মানুষ বসে রয়েছে, কিন্তু তাকে দেখা যাচ্ছে না, যেহেতু তার শরীর একেবারে স্বচ্ছ কোনো অজানা পদার্থ দিয়ে তৈরি । যেহেতু ‘ক’ বাবু বিজ্ঞানের খোঁজ খবর রাখেন না, তিনি দারুণ সংশয়াকুল ভাবে কথাটা তাঁর বন্ধু ‘খ’ বাবুকে বললেন, যিনি কি না বিজ্ঞানের ছাত্র।
কিন্তু ‘খ’ বাবুও এমন কোনো বস্তুর কথা ছাত্রজীবনে পড়েছিলেন বলে মনে করতে পারলেন না। কিন্তু তিনি তাঁর নিজের (এবং সামগ্রিকভাবে মনুষ্যজাতির) জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সজাগ, সুতরাং তিনি স্থির করলেন যে এবিষয়ে চটজলদি কিছু বলাটা ঠিক হবে না। তিনি আরো ভাবলেন যে, লোকটি নিশ্চয় একদম চুপচাপ এবং তার দেহ যন্ত্র এমনভাবে তৈরি যে, শ্বাসপ্রশ্বাসের দরকার কারণ তা না হলে নাড়াচাড়া শ্বাসক্রিয়ার শব্দ পাওয়া যেত। প্রচণ্ড বিভক্ত হয়ে ‘খ’ বাবু তাঁর এক ফিজিক্সে পি এইচ ডি করা এবং গবেষণারত তাকে বিষয়টা জানালেন।
সেই আত্মীয় একজন এর কাছে গিয়ে ব্যাপারটা সবিস্তারে বর্ণনা করলেন যিনি কিনা দায়িত্বশীল বিজ্ঞানী, তিনি নিজের চোখে না দেখে কিচ্ছুটি বিশ্বাস করেন না । তিনি সরেজমিনে তদন্তে গিয়ে স্বচক্ষে দেখলেন যে, যা বলা হয়েছে তাতে বিন্দুমাত্র ফাঁক নেই । তখন তিনি সঙ্গে সঙ্গে, ল্যাবরেটরি থেকে জিনিসপত্র আনিয়ে, প্রচণ্ড সতর্কভাবে, একজন সত্যিকারের সিরিয়াস ও নিরলস বিজ্ঞানকর্মীর মতো দু’টি এক্সপেরিমেন্ট করলেন।
প্রথমত, চেয়ারের ধার কাছ থেকে মেঝের কাছ ঘেঁষে কিছু বায়ু সংগ্রহ করে রাসায়নিক পরীক্ষাদ্বারা দেখলেন তাতে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ‘অনুপাত একেবারে স্বাভাবিক, অর্থাৎ চেয়ার সংলগ্ন অঞ্চলে শ্বাসপ্রক্রিয়া ঘটেছিল বা ঘটছে এমন প্রমাণ নেই। এই ফলাফল ‘খ’ বাবুর অনুমানকে সমর্থন করে, ‘খ’ বাবু সন্দেহ করেছিলেন অদৃশ্য লোকটির শ্বাসক্রিয়া হয় না।
দ্বিতীয়ত, তিনি ঐ গোটা চেয়ারটিকে বিদেশ থেকে আনানো উঁচুমানের নিখুঁত স্প্রিং ব্যালেন্স দিয়ে ওজন করলেন ; ফলাফল দেখে তাঁর চক্ষু স্থির হয়ে গেল । কি আশ্চর্য ! ঐ চেয়ারটির ওজন একেবারে একটি চেয়ারের ওজন যা উচিত, ঠিক তাই—একচুল বেশি বা কম নয় ! তাঁর বিন্দুমাত্র সন্দেহ রইল না যে হয় লোকটির ভর শূন্য বা প্রায় শূন্য, অথবা তার শরীর এমন কোনো পদার্থ দিয়ে তৈরি যার ওপর মাধ্যাকর্ষণের কোনো ক্রিয়া নেই। এবং শীঘ্রই যে বিজ্ঞানের জগতে একটি বিপুল আলোড়ন ঘটতে যাচ্ছে তা অনুমান করে তিনি যারপরনাই রোমাঞ্চিত হলেন ।
আর, প্রকৃত বিজ্ঞানীর মতো উপরিউক্ত পরীক্ষাগুলো বার বার করে নিঃসংশয় হবার চেষ্টা করতে লাগলেন । পরবর্তী ঘটনাবলী আরো সুদূরপ্রসারী। সেই ভদ্রলোক এক স্বনামধন্য প্রোফেসারের সঙ্গে এব্যাপারে কথা বললেন। প্রোফেসর নিজে গিয়ে সবকিছু দেখে শুনে ইন্টারন্যাশানাল বায়োফিজিসিস্ট ও বায়োকেমিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্টদের দু’খানা চিঠি লিখলেন। তখন পাঁচজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীকে নিয়ে একটি কমিটি তৈরি হল।
তাঁরা এসে অতি সূক্ষ্ম এক্সরে স্ক্যানার ও কম্পিউটার চালিত স্পেক্ট্রোমিটার দিয়ে কোন সজীব কোষ-কলা বা অস্থি- মজ্জার সন্ধান পেলেন না।
শেষ পর্যন্ত এক যুগান্তকারী রিপোর্টে যা লেখা হল তার সারমর্ম এই “যদিও আমাদের বর্তমানে সংগৃহীত জ্ঞান ও তথ্যের ভিত্তিতে এমন কথা বলা যাচ্ছে না যে, সাধারণ আলোক ও এক্সরে-র সাপেক্ষে সম্পূর্ণ স্বচ্ছ এবং প্রায় ভরশূন্য কোন সজীব অস্তিত্ব সম্ভবপর (বিশেষত এমনকি শ্বাসক্রিয়াও যেখানে অনুপস্থিত), তবু আমরা মনে করছি যে এ সম্পর্কে শেষ কথা বলতে গেলে দীর্ঘমেয়াদি অনুসন্ধানের দরকার আছে। সঠিকতম সিদ্ধান্তটি নেওয়ার জন্য আমরা অসীম সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে রাজি, এবং প্রত্যেক বিজ্ঞানমনস্ক লোকই তাই, আমরা আশা করি। আমরা এব্যাপারে পৃথিবী-ব্যাপী কর্মসুচি নেওয়ার প্রস্তাব রাখছি।”
এনিয়ে পৃথিবীর সমস্ত নামী কাগজেই লেখালেখি হল। যেকোনো বুদ্ধিসম্পন্ন লোকই বলবে, যে উপরিউক্ত উদাহরণটি পড়ে যেকোনো স্বাভাবিক ধরনের। কিন্তু কথা হল, প্রত্যেকেই জ্ঞানীগুণী, প্রতিটাই প্রাসঙ্গিক, পরীক্ষায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি উঁচুমানের এবং সেগুলো ঠিকই ফলাফল দিয়েছে, এমনকি ফলাফল থেকে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলোও সবই যুক্তিসম্মত ও সম্ভাব্য।”
সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ এই ক্ষেত্রে প্রশ্ন তুলতেই পারেন—চেয়ারে একটি অদৃশ্য মানুষ বসে আছে এরকম সন্দেহ করা হলো কেন ?
জনাম এইচ জি ওয়েলস্-এর ‘দি ইন্ভিজিল ম্যান’ উপন্যাসে যে ধরনের অদ্ভুত সব কাণ্ড-কারখানা ঘটেছিল, তা যদি না ঘটে তাহলে একজন সুস্থ, প্রকৃতিস্থ, স্বাভাবিক মানুষ এই ধরনের বিদ্ঘুটে সন্দেহ শুধু শুধু করতে যাবে কেন ?
এই প্রশ্নের উদয় হলেই অমন নিরলস গবেষণা অর্থহীন হয়ে পড়ে।
প্রকৃত গবেষকের চিন্তায় এই প্রশ্নটিই গবেষণায় নামার আগে খোঁচা দেয়, এটাই হলো বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান ও যুক্তিসম্মত অনুসন্ধানের প্রথমতম পর্যায়—হাইপোথিসিস্ বা প্রকল্প।
হাইপোথিসিস্ বা প্রকল্পটি যদি ভুল বা ভিত্তিহীন হয় তবে পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণের পথ ধরে এগুলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে হাস্যকর পরিণতি ঘটতে পারে।
এতক্ষণ যে কাল্পনিক উদাহরণটি আপনাদের কাছে হাজির করলাম, তাতে গবেষক পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে চাইলেও সিদ্ধান্তটি ভুল হয়েছে, কারণ হাইপোথিসিস্টাই ছিল ভিত্তিহীন।
তাই প্রতিটি গবেষণার শুরুতে সঠিক ফিজিবিলিটি বা হাইপথিসিস খুব ই গুরুত্ব পূর্ণ।