Colorgeo.com

Disaster and Earth Science

১৪-১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ; নেপথ্যে মর্মান্তিক ঐতিহাসিক সত্য

Spread the love

১৪-১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ; নেপথ্যে মর্মান্তিক ঐতিহাসিক সত্য

১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের শুরুতে পাকিস্তানি জেনারেল ইয়াহিয়া খান একটি মাস্টারপ্ল্যান করেন যেখানে পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হবে। সে ক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট সংখ্যক বুদ্ধিজীবী এবং এবং পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নের জন্য যারা ভবিষ্যতে অবদান রাখতে না পারবে এমন অগ্রগামী অরাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গদের হত্যা করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। নির্দিষ্টসংখ্যক এই বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন ব্যক্তিদের একজন করে করে হত্যা করা পাকিস্তান আর্মি দের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছিল, বিশেষত স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি অফিসার আইনজীবী ব্যবসায়ী এবং অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যক্তি বর্গদের হত্যা করা।

এ উদ্দেশ্যে জেনারেল ইয়াহিয়া খান পুলিশদের শক্তি সামর্থ্য বৃদ্ধি করে তাদের বিদ্যমান ভলান্টিয়ার ইউনিট যেমন মুসলিম লীগ, জামাতি ই ইসলাম এবং নিজাম ই ইসলাম এই সংগঠন গুলোর সাথে আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠন করেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষ সময়ে পাক আর্মিদের তত্ত্বাবধানে এদের কাজ হবে সন্দেহপূর্ণ ব্যক্তিদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে এসে আর্মিদের হাতে তুলে দেওয়া। কিছু কিছু সময় তারা মানুষকে হত্যা করত অনেক নির্যাতন করে। আর্মিরা এই বাহিনীকে অর্থ সহায়তা এবং অস্ত্র দিয়ে গাড়ি দিয়ে সাহায্য করত যাতে যেকোনো অপারেশন খুব দ্রুত করা যায়। মুক্তিযুদ্ধ সময়ে কমপক্ষে ৮০ জন শিক্ষাবিদ লেখক ডাক্তার সাংবাদিক এর লাশ রায়েরবাজার ইট ভাটা থেকে পাওয়া যায় এবং সে হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল ডিসেম্বরের 16 তারিখে, মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পনের কয়েক ঘণ্টা আগে।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সব কন্টেন্ট পড়ুন

প্রাথমিক তদন্ত কাজ শেষে জানা যায় যে প্রফেসর গোলাম সারোয়ার এবং মওলানা মওদুদী যারা আলবদর বাহিনীর শীর্ষে অবস্থানকারী দুইজন ব্যক্তি। পরবর্তীতে আলবদর বাহিনীর ক্যাম্প তল্লাশি করে যে কাগজপত্র এবং ডুকুমেন্ট পাওয়া যায় সেখানে দেখা যায় আলবদর বাহিনীর সদস্যরা মূলত ব্রিগেডিয়ার বশির লেফটেন্যান্ট কর্নেল রিজভী মেজর আসলাম এবং ক্যাপ্টেন কাইয়ুম এর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হতেন। এনারা পাকিস্তানি আর্মিদের, পূর্ব পাকিস্তান অংশের কমান্ডো। পরবর্তীতে জব্দকৃত কাগজপত্র আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করে যে পাক আর্মিরা আলবদর বাহিনীর সহযোগিতায় 3000 ব্যক্তির একটি লিস্ট তৈরি করেছিল যাদের মধ্যে প্রধানত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক লেখক ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার সাংবাদিক আর্টিস্ট ও কবিদের নাম ছিল তাদের সবাইকে হত্যা করার একটা সুপরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছিল।

এই তালিকাটি উদ্ধার করা হয় রাও ফরমান আলী নামের একজন ব্যাক্তির কাছ থেকে। এই হত্যা কাণ্ডটির কিছু অংশ ডিসেম্বর 16 তারিখের আগেই শেষ করা হয়েছিল কিন্তু পরিকল্পনাটি সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করা যায়নি কারণ সময় ছিল কম। ডিসেম্বর 16 তারিখের আগে ডিসেম্বর 13 এবং 15 এর মধ্যে ২৮০ জন খ্যাতিমান বাঙ্গালীদের হত্যা করা হয়েছিল যাদের মধ্যে 9 জন সাংবাদিক ছয়জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর। হত্যা করার জন্য প্রধানত দায়ী আলবদর বাহিনী। 140 জন ঢাকাতেই হত্যা করা হয়েছিল খুলনাতে 50 জন সিলেট 50 জন এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে ও 40 জনকে হত্যা করা হয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা মুক্তিবাহিনী ও ইন্ডিয়ার মিত্র বাহিনীর কাছে সর্বশেষ আত্মসমর্পণের মাত্র আধা ঘণ্টা আগে খুলনায় হত্যা করা হয় ।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে হত্যাযজ্ঞ শুধুই গুলি করে হত্যা করা ছিল নয় । প্রত্যেক ব্যক্তিকে দীর্ঘ সময় ধরে নির্যাতন করে হত্যা করা হত। কারো কারো আঙ্গুল ভেঙে দেয়া হয় শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিঁড়ে ফেলা হয়। রায়েরবাজার এখন যেটা বদ্ধভূমি নামে পরিচিত সেখানেও একই রকম নির্যাতনের চিহ্ন পাওয়া যায়। কারো নখ উল্টাদিকে উপড়ে ফেলা হয়েছে। এই নির্যাতনের কাজে কিছু কুখ্যাত ব্যক্তি জড়িত ছিল। শরীর থেকে হৃদপিণ্ড আলাদা করা হয়েছিল প্রধান হৃদ রোগ বিশেষজ্ঞ ঢাকা মেডিকেল কলেজ এর ডাক্তার ফজলে রাব্বী র । চোখ উঠিয়ে নেয়া হয়েছিল বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আলিম চৌধুরীর এবং আংগুল ভেঙে দিয়ে নির্যাতন করা হয়েছিল নিজাম উদ্দিন আহমেদকে যিনি একজন সাংবাদিক।

ডিসেম্বরের 13 তারিখ যখন কারফিউ চলমান তখন আলবদর বাহিনী এই সমস্ত মানুষদের কে ধরে নিয়ে আসে । সেলিনা পারভীনের ভাই যিনি শিলালিপি পত্রিকার সম্পাদক বলেন তার বোনকে কিছু মুখোশ পরিহিত মানুষ বাসা থেকে আনুমানিক দুইটার সময় ডিসেম্বর 14 তারিখে ধরে নিয়ে যায় । সশস্ত্র বাহিনী বাসার ভিতরে প্রবেশ করে এবং অস্ত্রের মুখে তাকে অনুসরণ করতে বাধ্য করে ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ডিসেম্বর 16 তারিখে রায়েরবাজার ইট ভাটা এলাকায় বর্তমানে রায়েরবাজার বধ্যভূমি তার নির্যাতিত লাশ পাওয়া যায়। আলবদর বাহিনীর সম্বন্ধে খুব অল্প কিছু জানা যায়। পরবর্তীতে দেখা যায় যে আলবদর বাহিনীর সহযোগিতায় পাকিস্তানি আর্মিরা হত্যাযজ্ঞ চালাতো রাজনৈতিক ভাবে এই সংগঠনটি একটি ধর্মীয় অনুশাসনের ভিত্তিতে মিলিটারি আদলে গড়া গোপন সংগঠন।

আলবদর বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে প্রধানত যুবক বয়সের সদস্য বেশি ছিল যাদের বয়সের ব্যবধান ১৮ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে হবে।  মুক্তিযুদ্ধ শুরু থেকে ই আলবদর বাহিনীর প্রধান কাজ ও মূল লক্ষ্য ছিল অমুসলিম এবং ভারতীয় অনুসারী যারা তাদেরকে নির্মূল করা । এই ধর্মান্ধ আলবদর বাহিনী কিছু বিদেশী দের থেকে কূটনৈতিক সহযোগিতা পেয়েছিল। বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ও লেখক জহির রায়হান বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এক রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন জানুয়ারি 29 তারিখে কিছু ঘাতক এর মাধ্যমে । জহির রায়হান একটি অনুসন্ধানমূলক রিপোর্ট তৈরি করছিলেন যেখানে দেখিয়েছিলেন যে আলবদর বাহিনীর প্রধান এবং আমেরিকান মিশন, ঢাকা এর গভীর যোগাযোগ রয়েছে। 

জহির রায়হানের ভাই শহীদুল্লাহ কায়সার কে হত্যা করার পর জহির রায়হান আলবদর বাহিনী এবং তাদের দ্বারা নির্যাতিত মানুষের খুনের রহস্য উদঘাটন করার জন্য একটি অনুসন্ধানমূলক কাজে হাত দেন। জহির রায়হান এর মতে স্বাধীনতা-পরবর্তী কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি আলবদর বাহিনীর সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল এবং আলবদর বাহিনীর মতাদর্শে তারা কাজ করতো। তখন জহির রায়হান শেখ মুজিবুর রহমান কে এই ধরনের কুখ্যাত ব্যক্তি বর্গের একটি তালিকা প্রদান করেন এবং বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করেন আটক করার জন্য। সম্ভবত এই ঘটনা আলবদর বাহিনীর জন্য একটি উদ্বেগজনক বিষয় ছিল। জহির রায়হান এবং তার বন্ধু আত্মীয়স্বজন মিলে একটি প্রেস কনফারেন্স এ বলেন শহীদুল্লা কায়সার এর হত্যাকান্ড আলবদর বাহিনী ও তার সহযোগীরা ধূর্ততার সাথে রং পরিবর্তন করে তৎকালীন স্বাধীনতা পরবর্তী দেশে ই রয়েছে।

ধর্মান্ধ আলবদর বাহিনী রায়হান কে হত্যা করেছিল কারণ রায়হান এর কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ছিল যদি এই সমস্ত তথ্য গুলো প্রেস কনফারেন্স করে প্রকাশ করা হয় তাহলে তারা জনরোষের সম্মুখীন হবেন। ৭ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদনে জহির রায়হান তথ্য উদঘাটন করে বলেন আলবদর বাহিনী এবং তাদের দোসর, জেনারেল ইয়াহিয়া সমর্থিত আর্মি বাহিনী এবং আমেরিকান মিশন, ঢাকা এদের একটি সঙ্গবদ্ধ যোগাযোগ ও চক্রান্ত রয়েছে।

সোভিয়েত ডেইলি নিউজ পেপার ইজভেশিয়া রিপোর্ট করার আগ পর্যন্ত জহির রায়হানের এই অভিযোগ গুরুত্বের সাথে দেখা হয়নি সেই রিপোর্টে বলা হয় আমেরিকান মিলিটারি বিশেষজ্ঞ গোপনে ১৯৭১ অক্টোবরের কোন  এক সময় পূর্বপাকিস্তানে এসেছিল।

জহির রায়হান ঢাকাতে নিজ উদ্যোগে জানুয়ারি ২৮ তারিখে একটি প্রেস কনফারেন্স ডাকেন। তার দুই দিন আগে একটা অপরিচিত টেলিফোন আসে তার কাছে এবং বলা হয় তার বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সার জীবিত এবং মিরপুরের কোন এক জায়গায় অবস্থান করছে যে ব্যাক্তি টেলিফোন করেছিল তিনি জহির রায়হানকে বলেছিল তার ভাইয়ের সাথে দেখা করতে এবং  শুধু মাত্র দুই থেকে তিনজন ব্যক্তির সাথে গোপনে আসতে এবং বিষয়টি গোপন রাখতে যতক্ষণ না তার ভাই মুক্ত হয়।

জহির রায়হান এর ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের বক্তব্যে জানা যায় যে জহির রায়হান তার ভাইয়ের খোঁজে মিরপুর গিয়েছিলেন। স্থানীয় পুলিশ এবং মুক্তি বাহিনীর সহযোগিতায় অনেক খোঁজাখুঁজি করা হয়েছিল তিন দিন ধরে কিন্তু জহির রায়হানের মৃতদেহটি ও পাওয়া যায়  না এবং সন্দেহ করা হয় তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। পড়ুন মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধমুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ গল্প

আল বদর বাহিনী কর্তৃক খুন হওয়ার পূর্বে ভিকটিমদের কাছে পাঠানো চিঠি ও হুমকি পত্র থেকে জানা যায় তাদের খুন করার উদ্দেশ্য। সেই চরম পত্রে লেখা থাকতো;

”তুই শয়তান । তুই আরো অন্যান্য শয়তানদের মত একজন এবং হিন্দু র দেশ ইন্ডিয়ার দালাল যারা চেষ্টা করছে পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুসলিম দেশ। তোর ব্যবহার, কর্মকাণ্ড সবকিছুই আমাদের নখদর্পণে । আমরা অতি শীঘ্রই তোর পরাজিত ইন্ডিয়ার সাথে সন্ধি ছিন্ন করব তাছাড়া তুই মুক্তি পাবি না। চিঠি পাওয়ামাত্রই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হ” [অনুদিত]