গনহত্যা কি?
যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য যখন পাকিস্থানী আর্মি অফিসার ওঁ তাদের সামরিক সহযোগীদের অভিযুক্ত করা হল তখন গন হত্যা অপরাধটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এজন্য গন হত্যা বলতে কি বোঝায়? কিভাবে একে সংজ্ঞায়িত করা হবে সেটা খুবই জরুরী বিষয়। আইনের দৃষ্টিতে সংক্ষেপে বলা যায় যে মানুষের দ্বারা কৃত সবথেকে ঘৃণ্য তম অপরাধ হল গণহত্যা।
গণহত্যা শব্দটি খুব বেশি পুরনো শব্দ নয়। আন্তর্জাতিক আদালতে এটা অতি সাম্প্রতি কালে সংযুক্ত করা হয়েছে। তবে নতুন সংযুক্তি হলেও এই ধরনের ঘৃণ্যতম অপরাধ মানুষ বহু বহু কাল আগে থেকেই করে আসছে। ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বর মাসে জাতিসংঘ গণহত্যা বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন করে। সেখানে উপস্থিত ছিল বিশ্বের সেরা সেরা আইনজ্ঞ ও পণ্ডিত।
তারা গণহত্যাকে একটি সুনির্দিষ্ট ভাবে সংজ্ঞায়িত করেন। গণহত্যা বলতে নিম্নের যেকোনো একটি কুকর্মকে বেঝাবে; যা কিনা কোন একটি গ্রুপ, সম্প্রদায়, জাতি, উপজাতি, সমাজ, ও দেশের অংশ বিশেষ বা সম্পূর্ণ অংশকে উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে করা হয়।
গনহত্যা কি কি কারণে হতে পারে?
১। কোন একটি গ্রুপের সদস্যদের হত্যা করা।
২। কোন একটি গ্রুপের সদস্যদের জঘন্য ভাবে শাররীক মানসিক ভাবে ক্ষতি করা।
৩। পরিকল্পিতভাবে কোন একটি গ্রুপের সদস্যদের স্থাবর সম্পত্তি সম্পূর্ণ অথবা আংশিক ধ্বংস করা।
৪। কোন একটি গ্রুপ, অথবা জাতির প্রজন্মকে ধ্বংস করার নিমিত্তে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির মত ব্যবস্থা আরোপিত করা।
৫। জোর পূর্বক কোন একটি দলের ছেলেমেয়েদের অন্য দলে অন্তর্ভুক্তিতে বাধ্য করা।
উক্ত সম্মলেনে এটা বলা হয় যে যুদ্ধের সময় অথবা অন্য যে কোন সময় এই গণহত্যা সংগঠিত হলে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। গন হত্যার বিষয়ক অপরাধের সাথে দুটি বিষয় অঙ্গা অঙ্গী ভাবে সম্পর্কিত (১) এটা প্রমাণ করার কোন প্রয়োজন নাই যে ক্ষমতাশীল দলের প্রধান গন হত্যা র জন্য কোন ধরনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন অথবা তার অধঃ স্থানীয় কর্তৃক গন হত্যা সংগঠিত হয়েছে।
যদি ক্ষমতাশীল দলের প্রধানের উদ্দেশ্য নাও থাকে তবুও তার সরকারের প্রতিনিধি বয়া অনুসারীদের দ্বারা সংগঠিত গন হত্যার অপরাধ কোন ভাবেই সরকার প্রধান হিসাবে দায় এড়ানো যায় না। এটা একটা স্বাভাবিক বিষয়। কারণ হিসাবে বলা যায় যে সুপ্রিম কমান্ডার সঠিক নির্দেশনা দিতে পারেননি, যাতে গণহত্যা এড়ানো যায়। এই ধরনের ঘটনা নুরেম্ববাগ যুদ্ধ অপরাদের বিচারের সময় এবং ভিয়েতনামের মাই লাই ম্যাসাকার এর বিচারের সময় আমেরিকার ও ইংল্যান্ডের দক্ষ বিচারক দ্বারা সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে যা কিনা বাংলাদেশের গনহত্যার সামিল।
অন্যদিকে, গন হত্যা বিষয়ক আন্তর্জাতিক আইন বলে যে উদ্দেশ্য প্রণোদিত ও পরিকল্পিত ভাবে যদি কোন দেশের রাজনৈতিক নেত্রীত্ব, ধর্মীয় নেতা, বুদ্ধি জীবি সম্প্রদায় বা কোন গ্রুপএর সদস্য দের নির্মূল করা হয় তবে তাকে গন হত্যা বলা হবে। এই বিষয়ে বাংলাদেশে সূস্পষ্ট স্বাক্ষ্য রয়েছে যে গনহত্যা সংগঠিত হয়েছে। একটি সূস্পষ্ট পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল যাতে পূর্ব পাকিস্থানকে মেধা শূন্য করা হয়। আর সেই কুপরিকল্পনায় কাজ করা হয় এবং পশ্চিম পাকিস্থানি সেনারা বাংলাদেশের বুদ্ধীজীবীদের হত্যা করে যাতে বাংলাদেশ অর্ধ শিক্ষিত অসহায় জনগণ অবশিষ্ট থাকে। এমনকি মিঃ ভুট্টোর দম্ভ উক্তিতে এর প্রমাণ মেলে।
সূক্ষ্ম তদন্তের মাধ্যমে ঘটনের উন্মেষ ঘটিয়ে ভবিষ্যতে এ ধরনের অপরাধ কমানো যেতে পারে। ইতিহাসে “মে লাই” বিচারের মাধ্যমে অনেক নবীন সেনা কমান্ডের এই ধরনের গর্হিত কাজ থেকে নিবৃত করা গিয়েছে। সমস্ত বেসামরিক পাকিস্থানিদের সম্মুখে প্রকৃত পক্ষ ঘটনার উন্মেষ ঘটলে যুদ্ধ অপরাধীদের বিচার তরান্বিত করা যায় অথবা পাক জনমন থেকে চিরদিনের মত তাদের নাম বিস্মৃত করা যায়। কারণ প্রকৃত ঘটনা সেই সময়ের নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় বেশিরভাগ অজানা থেকে গেছে। এর উন্মেষ ঘটিয়ে সম্মুখে আনা দরকার।
১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্থানে গন হত্যার ব্যাপারে বিস্তারিত জানা যায়। ঐ সময়ের প্রত্যক্ষ হত্যা কাণ্ড ঘটনার পরিধি ও ব্যপ্তি দেখে সহজেই বোঝা যায় যে এটা একটি “Genocide” গণহত্যা। যেখানে কিছু অমানুষ পরিকল্পিত ভাবে কোন সু নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ঘটিয়েছে।
১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্থানের সাধারণ নাগরিকদের নির্বিচারে হত্যা যেকোনো যুক্তি তর্কের ঊর্ধ্বের অপরাধ। পূর্ব পাকিস্থানের সমস্ত ছোট বড় শহরগুলোকে নিয়ন্ত্রণে এনে নির্বিচারে হত্যা অথবা বাঙালি মুক্তি বাহিনীদের দমন নিপীড়ন করার নামে পাকিস্থানি আর্মি অথবা গ্রামাঞ্চলে পাক বাহিনীর দোসর দের দ্বারা যেভাবে গন হত্যা চালান হয়েছে তা নজির বিহীন ঘটনা। এই সব ঘটনা গুলো পরিষ্কার ভাবে স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থানে অবস্থিত বিদেশি নাগরিকগণ বিশেষ করে মিশনারি গন এবং তারা আন্তর্জাতিক গন মাধ্যমে সময়ে সময়ে প্রচার করেছেন।
গনহত্যা হয়েছিল কিনা তার কিছু নমুনা এখানে কয়েকটি উদাহরণ দেয়া হলঃ
The New York Times, April 14, 1971: “Pakistani soldiers are burning houses to deny the resistance forces or hiding places. As the smoke from the thatch and bamboo huts billowed upon the outskirts of the city of Comilla, circling vultures descended on the bodies of the peasant, already being picked by dogs and crows”
বঙ্গানুবাদ- পাকিস্তানি সেনারা প্রতিরোধ ও গোপন আস্তানা ভেঙ্গে দিতে বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে। কুমিল্লা শহরে কুঁড়েঘর ও বাঁশের ঘর থেকে ধোঁয়ায় চারিদিক আচ্ছন্ন। উড়ন্ত শকুন মৃত দেহের চারিদিকে ঘুরছে, কাক ও কুকুরের মুতদেহ নিয়ে কাড়াকাড়ি।
Globe of Rio de Genairo, April 17, 1971: “The order now prevails in East Pakistan is the order of death, the order of cemeteries. A city was burned, the fire lasted three days, those who could flee from the town, only the dead remained.”
বঙ্গানুবাদ- পূর্ব পাকিস্থানে যদি কোন শৃঙ্খলা বিরাজ করা তা হলো মৃত্যু ও কবরের, একটি শহর আগুনে জ্বলছে তিন দিন ধরে, যারা পালাতে পেরেছে জীবন নিয়ে, বাকিরা মৃত।
The Sun, April 26, 1971:
“In one village 21 men were killed and in another 25. They were ordinary farmers, not a political agitator. Their crime was to vote for the Awami League.”
বঙ্গানুবাদ- একটি গ্রামে ২১ জনকে হত্যা করা হয়েছে অন্য গ্রামে ২৫ জন। তারা সবাই ছিল সাধারণ কৃষক, রাজনৈতিক কোন ব্যক্তি নয়। তাদের পঅপরাধ ছিল আওয়ামীলীগে ভোট দেয়া।
The Sunday Australian, June 06, 1971: “East Pakistan has had more than its share to disaster. It now ranks with Poland or Vietnam as the unluckiest country of modern time. Its barely six months since the cyclone devasted vast traces of the countryside and left thousands of people dead or homeless It is two months since the vengeful army of West Pakistan moved in to crush the local secessionist forces and begin their ritual campaign of killing and destruction.”
বঙ্গানুবাদ- পূর্ব পাকিস্থানে দুর্যোগের থেকেও বেশি কিছু ঘটছে। বর্তমান সময়ে পোল্যান্ড ও ভিয়েতনামের সমান দুর্ভাগা দেশে পরিণীত হয়েছে। গত ৬ মাস হল দেশটি বিপুল অঞ্চল জুড়ে সাইক্লোন আঘাতে হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে এবং গৃহহীন। গত ২ মাস ধরে পশ্চিম পাকিস্থানের ক্রোধান্বিত আর্মি রা ধ্বংস ও হত্যা যজ্ঞের অভিযান চালাচ্ছে।
Washington Daily News, June 30, 1971: In its treacherous attack starting March 25, the Pakistan Army has so far slaughtered 20,000 Bengalis and sent six million refugees fleeing for their lives into India.
বঙ্গানুবাদ- মার্চ মাসের ২৫ তারিখে ধ্বংসাত্মক আক্রমণের পড় থেকে পাকিস্থান আর্মি এ পর্যন্ত ২০ হাজার মানুষকে হত্যা করেছে এবং ৬ মিলিয়ন শরণার্থীকে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে।।
Writer
শিরোনামঃ গনহত্যা কি
Professor, Patuakhali Science and Technology University
More Stories
একুশে ফেব্রুয়ারি রচনাঃ ভাষা আন্দোলন কি
শেখ মুজিবুর রহমান ধ্বংসযজ্ঞ পরিদর্শন করে কি বলেছিলেন
Bangladesh Genocide became the most heinous crime by Pakistani Army in 1971 documented by World Record