ঘড়ির ভালোবাসা
আমি যখন জাপানে আসি তখন ঘড়ি পরার খুব শখ ছিল। তখন আমার কোন ঘড়ি ছিল না । আমরা বাংলাদেশ থেকেই শুনেছিলাম যে জাপানের ঘড়িগুলো খুব উন্নত মানের এবং সঠিক সময় দেয়। তাই জাপানে এসে প্রথমেই একটি ঘড়ির দোকানে গেলাম । সেখানে গিয়ে দেখলাম যে ঘড়ি গুলো অনেক দামি 10 হাজার জাপানি ইয়েন। আমার কাছে অত টাকা ছিল না যে আমার শখ পূরণ করতে পারব তাই ঘড়ি কেনার ইচ্ছাটা আপাতত বাদ দিলাম। ঘড়ি ছাড়াই আমি স্কুলে যেতাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পৃথিবী বিজ্ঞান বিভাগে।
বাংলাদেশ থেকে যারা আসে তারা সাধারণত প্রথম দিকে সস্তা দোকান খুঁজে এবং পুনরায় ব্যবহার যোগ্য জিনিসপত্রের দোকান যার নাম বুক অফ। এই দোকানটা সবার পছন্দ কারণ এখানে দামি জিনিসপত্র মেরামত করে ও একটু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে বিক্রি করা হয়।
জাপানে একশত টাকার মধ্যে পাওয়া জিনিসের একটি দোকান রয়েছে। সেই দোকানগুলো বলা হয় হাকুয়েন । অর্থাৎ যে জিনিসটি কিনব আমরা ১০০ টাকার মধ্যে পেয়ে যাব। একদিন বিকেলে আমরা শহরে ঘুরতে গিয়ে হাকুইয়েন দোকানের সন্ধান পেলাম। সেখানে ঘুরতে ঘুরতে একটি ঘড়ির কর্নার দেখলাম। ঘড়িগুলোর দাম একশত টাকা।
আমি তো দেখেই অবাক হয়ে গেলাম যে একশত টাকায় ঘড়ি পাওয়া যায় । আমি ঘড়িগুলোর ঝোলানো অবস্থায় একটা একটা করে পছন্দ করতে থাকলাম। এরপর আমার পছন্দের একটি ঘড়ি ১০০ টাকা দিয়ে কিনে নিলাম। প্লাস্টিকের ফিতা এলাম ক্লক রয়েছে আবার রাত্রে সময় দেখার জন্য লাইট রয়েছে দুই পাশে বাটন কালো রঙের ডিজিটাল ঘড়ি। সুন্দর সময় দিচ্ছিল। কোন অসুবিধা নেই তবে একটি অসুবিধা হলো জলে ভেজানো যাবে না । ওয়াটার প্রুফ নয় ।
ঘড়িটি ছয় মাস ব্যবহার করলাম একটানা এবং কখনোই হাত থেকে খুলি না শোয়ার সময়ও শুধুমাত্র গোসল করার সময় ঘড়িটি খুলে রাখি। কারণ জাপানের সবাই সময় সচেতন যেমন বারোটার সময় খাওয়া সন্ধ্যা ছয়টার সময় খাওয়া সকাল ৯ঃ০০ টার সময় স্কুলে যাওয়া তেমনি অনেক নিয়ম রয়েছে যেগুলো সময়ের সাথে সাথে করা হয়। নিয়মের ব্যত্যয় ঘটানো হয় না।
ছয় মাস একটানা ঘড়ি পড়ার পরে আমার ঘড়িটির প্রতি মায়া এসে গেল। সেই সাথে আরো ভালো ঘড়ি পড়ার একটি শখ জাগলো। তখন অন্য একটি দোকান নাম বুক অফ, এখানে অনেক দামি ঘড়িগুলো সাজানো থাকে কাছের বাক্সের মধ্যে তুলনামূলক কম দামে। আমরা দুজন স্বামী-স্ত্রী গেলাম সেখানে শপিং করতে হঠাৎ আমার চোখে একটি ঘড়ি দৃষ্টি আকর্ষণ করল । ঘড়িটির দাম ১০ হাজার জাপানি টাকা।
যেহেতু ঘড়িটির দাম একটু বেশি তাই আমি কেনার সাহস পেলাম না তবে ওই দোকানে একটি ডিসকাউন্ট এর ব্যবস্থা রয়েছে। মাঝেমাঝে কোন কোন আইটেম গুলোতে ডিসকাউন্ট ট্যাগ লাগানো হয়, যদি সেগুলো দীর্ঘদিন ও বিকৃত থাকে । তাই আমিও ঘড়িটি ডিসকাউন্ট ট্যাগ লাগানোর অপেক্ষায় থাকতে লাগলাম । অন্য আরেকদিন গেলাম দোকানে দেখি সেখানেই রয়েছে ঘড়িটি । ওইখানেই রয়েছে আগের দামেই একটুও দাম কমেনি । ঘড়িটিকে আমি আমার স্ত্রীকে দেখালাম বললাম এটা আমার খুব পছন্দের।
তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কাজে মনোনিবেশ করতে গিয়ে খুব বেশি আর সেই দোকানে যাওয়া হয়নি হয়তো ঘড়িটির কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। ইতিমধ্যেই আমার জন্মদিনের একটি সন্ধ্যার দিকের ঘটনা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাসায় ফিরেছি বাচ্চারা বাসায় রয়েছে আমার স্ত্রী ও বাসায় ফিরেছে তার হাতে একটি ব্যাগ । আমাকে ঘড়িটি উপহার দিয়ে বলল হ্যাপি বার্থডে টু ইউ । আমি তো অবাক। সেই ঘড়িটি হাতে পেয়ে মহা খুশি হলাম স্ত্রীকে একটু জোরে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নাচালাম বাচ্চাদের সামনে । বললাম ইউ আর সো কেয়ারিং বউ।
উপহার হিসেবে ছেলেরা এখনো ঘড়িকে প্রথম শ্রেণীতে রেখেছে। বর্তমান আধুনিক যুগে ঘড়ির গুরুত্ব কমে যায়নি এতটুকু। ঘড়ি যেমন একটি আভিজাত্যের প্রতীক আবার সময় দেখার কাজে লাগে।
যারা জীবনটাকে সময়ের প্রেমে বেধে ফেলতে চান তাদের জন্য ঘড়ি খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি মুহূর্তে আমাদের ঘড়ির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
ভালোবাসার উপহার হিসেবে ঘড়ি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই ঘড়িটি আমাকে উপহার হিসেবে দিয়েছিল আমার ভালোবাসার মানুষটি। এতটা বছর পরে এসেও যখন আমি অতীতে ফিরে যাই তখন সেই সুন্দর মুহূর্তের কথাটি মনে পড়ে। সেই সময় সেই ঘড়ি আগের মতোই রয়েছে কিন্তু মাঝে চলে গেছে দশটি বছর।
এই ঘড়িটি অনেক ঘটনার সাক্ষী হিসাবে রয়েছে আমার কাছে। একটা কথা আছে যে সুখে থাকতে ভুতে কিলায়। কিছু জিনিস যখন মানুষকে অন্ধ করে ফেলে তখন সে অতীতের সব কিছু ভুলে যায়। মানুষের সব থেকে বড় পরিচয় যে সে মানুষ অর্থাৎ মনুষ্যত্ব গুণ অর্জন করা। কিন্তু মানুষ যখন মনুষ্যত্ব হীন হয়ে পড়ে তখন তার থেকে চির বিদায় নেয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। কোন মানুষ যখন অল্পত্বেই অনেক বেশি পেয়ে যায় তখন তারা অকৃতজ্ঞ হয়ে যায়। এমন মানুষ সমাজের অন্য মানুষ গুলোকে শান্তিতে রাখে না।
দাম্পত্য জীবনে সুখী হতে হলে ঘড়ির মত হতে হয়। ঘড়ি যেমন নীরবে বয়ে চলে শত বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে। সময় যেমন বয়ে চলে। দাম্পত্য জীবনে প্রতিটি স্বামী এবং স্ত্রীকে একে অপরের পাশে এভাবেই চলতে হয়। একে অপরের প্রতি সম্মান বিশ্বাস ও ভালোবাসা না থাকলে দাম্পত্য জীবন থেমে যায় এক্ষেত্রে স্বামী বা স্ত্রী দুজনই কষ্ট পায় তাদের সন্তান-সন্ততি তারাও নির্ধারণ কষ্ট অনুভব করে পিতা-মাতার ভালোবাসা থেকে তারা বঞ্চিত হয়।
এই ঘড়িটি আমার জীবনের জন্য একটি মূল্যবান উপহার যখনই আমি ঘড়িটির দিকে তাকাই তখনি আমার প্রিয় মানুষটির কথা মনে পড়ে এবং ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে যায়।
আমরা এখন একে অপরের থেকে যোজন যোজন দূরে মানসিকভাবে ও শারীরিকভাবে। সে আমাকে মন থেকে মুছে ফেলেছে বহু আগেই। আমার কাছে রয়েছে তার সমস্ত স্মৃতি আর এই ঘড়িটি। আমি এখন সময় কাটাই ভালোবাসাহীন নিঃসঙ্গতায় একাকী।