Colorgeo

Classroom for Geology and Disaster

জাপানে প্রবাসীদের জীবনের গল্প

Spread the love

জাপানে প্রবাসীদের জীবনের গল্প

প্রবাসে মা নেই বলেই প্রবাস জীবন এত কঠিন। বাংলাদেশ থেকে যারা জাপানে প্রবাসী তাদের গল্পই আজকে বলবো। যারা প্রবাসে থাকে তাদের জীবন সর্বদাই কষ্টের কারণ প্রবাসে আসে মানুষ কাজ করতে গল্প বা খেলাধুলা করতে আসে না। প্রবাসে আসা মানেই কষ্টের জীবন। কাজের জীবন। প্রতিটি মুহূর্তই কর্ম করে খেতে হয়। কাজ করে যেতে হয়। কাজের মধ্যেই যদি কখনো খেলার সুযোগ হয় আনন্দ করার জন্য এখানে বাড়তি কোন সময় দেয়া হয় না। কাজের ফাঁকেই বের করে নিতে হয় এটাই প্রবাস জীবন। প্রবাসে আসলে মানুষ ভাগ্যের উন্নয়ন করার লক্ষ্যে জীবনটাকে সুন্দরভাবে সাজানোর জন্য আসে। তাই মানুষ প্রবাসে এসে শুধু কাজ করে। আজ আমি আমার পরিচিত কিছু প্রবাসীদের জীবনের গল্প বলবো। প্রবাসীদের জীবনের গল্প ক্ষেত্রে অজানা থাকে কারণ তারা মুখফুটে কারো কাছে বলতে পারেনা তবে আমার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কিছুটা শেয়ার করব যারা জাপানে আসার জন্য পরিকল্পনা করছেন।

জাপানে বাংলাদেশী প্রবাসীদের জীবনের গল্প আসলে কেমন?

জাপানে বাংলাদেশী প্রবাসীদের জীবনের গল্প তুলনামূলক ভালো কারণ জাপান দেশ হিসেবে অনেক উন্নত এবং ভদ্র জাতি। এখানে কোন বৈষম্য নেই তবে কাজ ছাড়া এখানে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ কম।

বাংলাদেশ থেকে যারা কলেজ পাস করে এইচএসসি পাস করে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চশিক্ষার জন্য চার বছর এবং মাস্টার্স পাশ করার জন্য আরো এক বছর পড়াশোনার চিন্তা করে থাকে তাদের জন্য জাপানের প্রবাস জীবন ও চাকরি হতে পারে একটি বিকল্প চিন্তা।

বাংলাদেশে বর্তমানে উচ্চশিক্ষিত হলেই চাকরি পাওয়া যাবে এমন কোন নিশ্চয়তা নেই তাই ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পরে যদি কেউ জাপানে আসার পরিকল্পনা করে তবে তার জন্য ভবিষ্যতে ভালো হবে কারণ যতদিনের সে মাস্টার্স পাস করবে ততদিনে জাপানের সে ভালো একটি চাকরি পেয়ে যাবে এবং প্রতি মাসে বাংলাদেশ টাকার ২ লাখ টাকা পর্যন্ত বেতন পেতে পারে।

জাপানে আসার জন্য বর্তমানে ভাষা শিক্ষা কোর্স জাপানিজ ল্যাঙ্গুয়েজ কোর্সের মাধ্যমে আসা যায় এটাই সব থেকে সহজ পথ বিশেষ করে ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পরে।

প্রবাসী হিসেবে আমার জীবনের গল্প

প্রবাসীদের জীবনের গল্প

২০১৪ সালে আমি জাপানে প্রথম আসি এরপরে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এখানে স্নাতক ডিগ্রী সম্পন্ন করি এবং পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করি এরপর বাংলাদেশের ফিরে যাই এবং দ্বিতীয়বার জাপানে আসি ২০২২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এবং ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে আমি জাপানের বিশ্ববিদ্যালয় বিদেশি গবেষক হিসেবে কর্মরত আছি।

এ বিশ্ববিদ্যালয় আমি কাজ করি বিনা বেতনে। বাংলায় আমরা যা যাকে বলি বেগার দেওয়া।

আমরা গ্রামে দেখতাম যে আমাদের বাড়িতে যদি কোন বড় কোন কাজ করা লাগতো তখন গ্রামের সবাইকে ডাকা হতো মাংস রান্না করা হতো সবাই কাজ শেষে খেয়ে যেত এটাকে বলা হয় ব্যাগর দেওয়া আমিও ঠিক সেই কাজটাই করছি।

আমি প্রতিদিন নটার সময় ল্যাবে আসি দুপুর বারোটায় বাসায় যাই সন্ধ্যা ৬ঃ০০ টার সময় বাসায় যাই এবং রাত দশটা পর্যন্ত কাজ করি বারোটার সময় ঘুমাই আবার সকাল ৯ঃ০০ টার সময় চলে আসি এই সবগুলো কাজ করি প্রফেসরকে সাথে নিয়েই । আমি যেখানেই যাই প্রফেসর আমার সাথেই থাকে, টয়লেট এবং স্নান করা সময় বাদ দিয়ে। আসলে আমরা দুজন বন্ধু ও সুপারভাইজার ছাত্র সম্পর্ক।

আমরা ঘুরতে যাই একসাথে আমরা বাজার করতে যাই একসাথে আমরা শপিং মলে যাই সাথে আমরা ক্লাসে যাই একসাথে আমরা গবেষণার করার সময় একই রুমে কাজ করি। প্রফেসরের গাড়িতেই সব সময় ঘুরি তাই আমি একটি প্রস্তাব দিলাম যে চলো সমুদ্র দেখে আসি সে সহজেই রাজি হয়ে গেল। ভাবছি সমুদ্র দেখতে যাব এবং সেখানে গিয়ে অনেক সামুদ্রিক শামুক ও ঝিনুক গুলো ধরবো এবং পুড়িয়ে খাব সে ব্যবস্থাও নাকি সেখানে আছে আমাকে সেটাই বলা হলো।

মাঝে মাঝে বন্দী জীবন মনে হয়। মনে হয় যেন দূরে কোথাও একটু ঘুরে আসি একা পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকি।

সেদিন মোটর লাগানো ইলেকট্রিক সাইকেল টা নিয়ে চলে গেলাম অনেক দূরে পাহাড়ের কাছে সেখানে গিয়ে কিছুটা সময় পাহাড় দেখলাম একটু ঘাসের ভিতর বসলাম খালি পায়ে হাঁটলাম তারপর সর্ষে খেতে পাশে বসে কিছুটা ধীরে ধীরে বাতাস উপভোগ করলাম আর দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়কে দেখতে থাকলাম পাশেই নদী ছিল নদীর পাশেই প্রশস্ত রাস্তা দিয়ে ব্যস্ততম গাড়িগুলো দ্রুত চলে যায় বিকেলের স্কুলের ছেলে মেয়েরা জাপানিজ ব্যাগ গুলো হাতে নিয়ে বাড়ি চলে যায়। ছোট ক্যানাল সদৃশ্য নদীতে রুই মাছ গুলো খেলা করছিল সেটা দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে গেলে তারপর বাসায় ফিরে আসলাম এভাবেই একটি দিন কাটালাম।

আমি গবেষণা নিয়ে খুব বেশি সচেতন না। আসলে গবেষণা আমার ভালো লাগেনা । তবে আমার কি ভালো লাগে আমি এখনো সেটা বুঝে উঠতে পারিনি। এখনো আমার ভালো লাগার বিষয়টা খুঁজে চলেছি এই যেমন মানুষকে নিয়ে সমালোচনা করতে ভালো লাগেনা গভীরভাবে ভালোবাসবো এটাও চিন্তা করতে ভালো লাগেনা। তবে মাঝে মাঝে মনে হয় দূরে কোথাও পাহাড়ের ধারে সমুদ্রের ধারে গিয়ে সময় কাটাই বসে থাকি সমুদ্রের নীল জল দেখি ঢেউগুলো কিভাবে আছড়ে পড়ে সেটা দেখি। মানুষগুলো কিভাবে সমুদ্রের তপ্ত বালুকায় হেঁটে বেড়ায় সেগুলো দেখি । সমুদ্র এবং পাহাড় আমাকে টানে।

 

জাপানে মা নেই বলে একটু মন খারাপ হয় মাঝে মাঝে কারণ যেখানে মা থাকে না সেখানে দীর্ঘদিন থাকা যায় না, একটা সময় বিষন্নতা চলে আসে । তাই মনে হয় বাংলাদেশের ফিরে যাই যদিও ফিরতেই হবে একটা সময় । তাই প্রবাসীদের জীবনের গল্প প্রকৃতপক্ষে অনেক আনন্দের মধ্যেও বেদনা।

জাপানে প্রবাসীদের জন্য সমস্ত সুযোগ সুবিধা উন্মুক্ত রয়েছে। যদি কেউ অ্যালকোহল পান করতে ইচ্ছা পোষণ করে সহজেই সে সেটা পান করতে পারবে। আমি যখন জাপানে প্রথম আসি তখন আমাকে ঘিরে একটি অনুষ্ঠান হয়েছিল ওয়েলকাম পার্টি সেখানে আমাকে বলল তুমি কি মদ্যপান করবে নাকি কমলার জুস খাবে আমি সৌজন্যতার খাতিরে বললাম আমি কমলার জুস খেতে চাই তবে আমি ইচ্ছা করলে সেদিনও মদ্যপান করতে পারতাম। জাপানের দক্ষিণে হিরোশিমা প্রদেশের কাছে পাহাড়ে আমরা রাত্রি যাপন করলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসরদের নিয়ে এবং ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে সেখানে রাত্রে বারবিকিউ পার্টি হলো পার্টিতে মদ থাকবে না এটা তো হতে পারে না পর্যাপ্ত পরিমাণে মদের প্যাকেট চলে আসলো এবং মাংসের প্যাকেট। পুরো দস্তুর শুরু হয়ে গেল সন্ধ্যার পর পর বারবিকিউ পার্টি মধ্যরাত্রে পর্যন্ত চলল। বনের মধ্যে ছোট্ট একটা ঘর পরিত্যক্ত ঘর একজন মহিলা এসে ঘরের চাবি দিয়ে গেল এবং সেখানে কোন বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই স্বভাবতই শীতের রাত আমরা ঘরের মধ্যে কেরোসিন এর হিটার চালিয়ে তার চারিপাশে গোল হয়ে বসলাম এবং যে যা পারে তাই পরিবেশন করতে থাকলাম কেউ নাচ দেখালো হঠাৎ উঠে গিয়ে কেউ গল্প করছে কেউ কৌতুক করছে আমি একটি গান শুনালাম, মধু হই হই বিষ খাওয়াইলা ।।।। ওরা গান শুনে আমার টাইটেল দিল মাধু হই হই। যখনই আমাকে দেখে ওরা বলে মাধু হই হই আর হেসে ফেলে। পার্টি অনেক মজা হল তারপর আমরা ভূতাত্বিক ফিল্ড ওয়ার্ক শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় ফিরে আসলাম।

জব ভিসায় আসা প্রবাসীদের জীবনের গল্প

বাংলাদেশ থেকে যারা জব ভিসায় প্রবাসী আসে বিশেষ করে জাপানে তাদের জন্য সুন্দর জীবন কাটানোর সুযোগ থাকে। কোন জব একটা ভালো না লাগলে সে জব পরিবর্তন করার সুযোগ রয়েছে এখানে তাই জব ভিসায় আসা প্রবাসীদের জীবনের গল্প অনেক ভালো ও মধুর। তারা ইচ্ছা করলে তাদের স্বামী বা স্ত্রীদের নিয়ে আসতে পারবে এবং একসাথে থাকার সুযোগ রয়েছে জাপানে।

স্টুডেন্ট ভিসায় আসা প্রবাসীদের জীবনের গল্প

ভাষা শিক্ষার কোর্সে অংশগ্রহণ করার উদ্দেশ্যে স্টুডেন্ট ভিসায় আসা প্রবাসীদের জীবনের গল্প একটু জটিল কারণ তাদের পড়াশোনা শেষ করে জব খুঁজে নিতে হয়।

বাংলাদেশ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে আসা ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের দুই বছর ভাষা শিক্ষা কোর্স এ অংশগ্রহণ করতে হয় এরপরে আরো দুই বছরের জন্য যেকোনো ধরনের ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হতে হয়, ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করার পরে তারা ভালো চাকরির জন্য দরখাস্ত করতে পারে তবে যারা বাংলাদেশ থেকে ইতিমধ্যেই মাস্টার্স সম্পন্ন করেছে তারা ভাষা শিক্ষা কোর্স কমপ্লিট করার পরেই জবের জন্য দরখাস্ত করতে পারে । জাপানের বিভিন্ন কোম্পানিগুলোতে একটি চাকরি পাওয়ার পরে প্রবাসীদের জীবন অনেক সুন্দর হয়ে যায় তারা ইচ্ছা করলে তাদের পিতা-মাতা কে জাপানে বেড়াতে নিয়ে আসতে পারে।

স্টুডেন্ট ভিসায় যারা আসে তারা ভাগ্যের উন্নয়নের জন্য এখানে আসে ভালো একটি কোম্পানিতে চাকরি পেলে তাদের সেই স্বপ্ন পূরণ হয়। তারা বাংলাদেশ এ টাকা পাঠাতে পারে এবং তাদের জীবনকে উন্নত করতে পারে । প্রতি মাসে তারা দুই থেকে আড়াই লাখ টাকার বেতনের চাকরি পেতে পারে জাপানে আসার পরে।

বাংলাদেশীদের জন্য জাপানে প্রবাসীদের গল্প তুলনামূলক ভালো বলা যায় কারণ এখানে কোন রকম প্রতারণার আশ্রয় নেয়া হয় না। জাপানে নিয়ম মাফিক চলতে পারলে সুন্দরভাবে জীবন কাটানো যায় তবে আনন্দ উল্লাস নিজের মধ্যে সময় বের করে নিতে হবে।

তবে প্রবাসীদের জন্য সবসময়ই বিদেশ অনেক বেদনার। বাংলাদেশ সবসময়ই আমাদেরকে টানে কারণ সেখানে আত্মীয়-স্বজন মা-বাবা বন্ধু বান্ধব সবাই রয়েছে। জাপানে বাংলাদেশী প্রবাসীরা বাংলাদেশের যেসব খাবারগুলো মিস করে তার বিকল্প জাপানে নেই।

প্রবাসীদের জীবনের গল্প জানতে আমাদের সাথেই থাকুন।

ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পরে যদি কেউ জাপানে আসতে চায় তাহলে নিম্নের ঠিকানায় যোগাযোগ করতে পারে।

ইমেইল ramanbiswas@pstu.ac.bd