Colorgeo

Classroom for Geology and Disaster

Spread the love

পানির খনিজ রহস্য

প্রাক-ঐতিহাসিক যুগ থেকে আজকের আধুনিক যুগ পর্যন্ত মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে খনিজ পদার্থ। আজ পর্যন্ত পাথুরে লবণ থেকে শুরু করে স্বর্ণ, লোহা, দস্তা, তামা, রূপা, হীরাসহ প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার রকমের খনিজের সন্ধান আমরা পেয়েছি।

আধুনিক যুগের বিদ্যুৎ, কম্পিউটার, মোবাইল, রেফ্রিজারেটর, বিমান, রকেট তৈরি সহ নানান গুরুত্বপূর্ণ কাজে এমনকি মেয়েদের রূপচর্চার জন্য মেকাপ ইন্সট্রুমেন্ট তৈরিতেও খনিজের ভূমিকা অপরিসীম। আপনি কি জানেন এই লোহা, তামা, রূপা, হীরা বা পাথুরে লবন কে খনিজ হিসাবে গণ্য করা হয় কেন?

কোন পদার্থ খনিজ হিসাবে বিবেচনা করার জন্য ৫ টি প্রধান শর্ত পূর্ণ করতে হবে। তা হলো,

১. প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট হতে হবে,

২. অজৈব পদার্থ হতে হবে,

৩. কঠিন পদার্থ হতে হবে,

৪. নির্দিষ্ট কেমিক্যাল কম্পোজিশন থাকতে হবে,

৫. সুনির্দিষ্ট পারমাণবিক গঠন থাকতে হবে।

উক্ত ৫ টি শর্তের একটি শর্ত যদি কোন পদার্থের অনুপস্থিত থাকে তাহলে তাকে খনিজ বলে গণ্য করা হবে না।

এখন আসুন আমরা সবাই একটু জেনে নেই প্রতিটি প্রাণের বেঁচে থাকার প্রধান উপাদান “পানি” কি খনিজ পদার্থ? পানি হলো স্বাদহীন, বর্ণহীন, গন্ধহীন একটি রাসায়নিক পদার্থ, যা জীব (প্রাণী ও উদ্ভিদ) কোষের একটি প্রধান উপাদান। এখন আমরা যদি পানিকে খনিজের সেই ৫ টি শর্তের সাথে তুলনা করি তাহলে দেখা যায় পানি ৪ টি শর্ত পূর্ণ করতে সক্ষম হয় তা হলো,

১. পানি প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট

২. পানি অজৈব পদার্থ অর্থাৎ একটি কোন জীবের ধ্বংসাবশেষ হতে সৃষ্টি নয়,

৩. পানি তরল পদার্থ। (যা গ্রহণ যোগ্য নয়)

৪. নির্দিষ্ট কেমিক্যাল কম্পোজিশন আছে। হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেন, এ দুটি উপাদানের সমন্বয়ে তৈরি হয় পানি। পানির রাসানিক নাম হলো ড্রাই হাইড্রোজেন মনো অক্সাইড (H2O)।

৫. সুনির্দিষ্ট পারমাণবিক গঠন আছে, একেকটি পানির অণু একটি অক্সিজেন পরমাণু ও দুটি হাইড্রোজেন পরমাণুর সাথে সমযোজী বন্ধনে গঠিন।

অর্থাৎ খনিজের ৩ নং শর্তের সাথে পানির বৈশিষ্টের অমিল বিধায় পানিকে খনিজ হিসাবে গণ্য করা যাবে না। আবার আমরা সকলেই জানি যে, তাপমাত্রার প্রেক্ষিতে পানি কঠিন, তরল ও বায়বীয় এই ৩ টি অবস্থায় বিরাজমান।

এক বায়ুমন্ডলীয় চাপে ০-১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যে পানি তরল অবস্থায় থাকে। ০ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পানি জমে কঠিন অবস্থা বরফে পরিণত হয় এবং ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পানি বায়বীয় অবস্থা জলীয় বাষ্পে পরিণত হয়।

খনিজ

 

এখন সবার মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে যে পানি যখন কঠিন বরফ অবস্থায় থাকে তাহলে তাকে খনিজ বলা যাবে কিনা? হ্যাঁ, তখন সেই কঠিন বরফকে খনিজ বলা যাবে কারণ বরফ অবস্থায় পানি খনিজের সকল শর্ত পূর্ণ করতে সক্ষম।

তবে তরল পানিকে যদি কৃত্রিম উপায়ে কঠিন বরফে পরিণত করা হয় অর্থাৎ রেফ্রিজারেটর বা এরকম হিমযন্ত্র ব্যবহার করা হয়, সেক্ষেত্রে তাকে খনিজ বলে গণ্য করা হবে না। কারণ খনিজ হতে হলে অবশ্যই তাকে প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট হতে হবে। এই খনিজের উত্তম উদাহরণ হলো শিলাবৃষ্টির শিলাখন্ড, তুষারকণা, সমুদ্রের বরফ প্রভৃতি।

এখন অনেকেই ভাবতে পারেন আমরা যে প্রতিনিয়তই মিনারেল ওয়াটার বা খনিজ পানি শব্দটি ব্যবহার করে থাকি তাহলে এটা কি ভুল শব্দ? আসলে মিনারেল ওয়াটারে মিনারেল শব্দটা একটু ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। এখানে মিনারেল বলতে বুঝানো হয়েছে পানিতে দ্রবীভূত বিভিন্ন খনিজ পদার্থকে।

মিনারেল ওয়াটারের প্রধান উৎস হলো বৃষ্টির পানি, ঝর্ণা, ভূগর্ভস্থ পানি, তুষারগলা পানি প্রভৃতি। এককথায় প্রকৃতিতে প্রাপ্ত প্রাকৃতিক জল, যা পানযোগ্য তাকেই মিনারেল ওয়াটার বলে। এসকল পানি প্রকৃতি থেকে পাওয়া যায় বিধায় এর সাথে বিভিন্ন খনিজ ও অন্যান্য পদার্থের সাথে সম্পৃক্ততা থাকে।

ফলে খনিজ লবন, লৌহ, জিংক, সীসা, কপার ইত্যাদি খনিজসমূহ দ্রবীভূত অবস্থায় পানির সাথে মিশে থাকে বলেই উহা খনিজ পানি বা মিনারেল ওয়াটার নামে পরিচিত

তবে যেভাবে পেট্রোলিয়াম, প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা প্রভৃতি খনিজ পদার্থ না অথচ খনিজসম্পদ হিসাবে বিবেচনা করে ঠিক সেভাবেই পানিকেও খনিজসম্পদ হিসাবে বিবেচনা করে।

কিছু কিছু বিজ্ঞানীদের মতে এধরনের (কয়লা, পানি, খনিজ তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস) পদার্থকে মূলত “মিনারেলয়েড” হিসাবে ধরা হয়। মিনারেলয়েড হলো সেই সকল পদার্থ, যা খনিজ পদার্থের মতোই কিন্তু খনিজের ৫ টি শর্তের যেকোন একটি বা দুটি শর্ত পূর্ণ করতে পারে না।

সর্বোপরি, পানি খনিজ পদার্থ না হলেও অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূণ প্রাকৃতিক সম্পদ। যার সম্পর্কে আমাদের সকলেরই নূন্যতম ধারণা থাকা আবশ্যক।

লেখকঃ মোঃহাবিবুল্লাহ,
বিএসসি ইন মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিং,
চায়না ইউনিভার্সিটি অব মাইনিং এন্ড টেকনোলজি