গত কয়েক বছরের জলবায়ু ও আবহাওয়ার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর বিভিন্ন স্বল্পোন্নত দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিমান তুলনামূলক হারে বাড়ছে। বিশ্বের উন্নত ও ধনী দেশ গুলোতে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণেই স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘন ঘন হচ্ছে। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দেশের মানষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে।
দুর্যোগ ও বিপর্যয়ঃ
দুর্যোগের কথা বললেই বিপর্যয় শব্দটি এসে যায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে দুর্যোগ ও বিপর্যয় সম্পূর্ণ আলাদা দুটি বিষয়।
বিপর্যয়ঃ প্রথমেই আসি বিপর্যয় মানে কী? আজকে রাতে ঘূর্ণিঝড় হতে পারে। আজকে বৈশাখী ঝড় হতে পারে। এ ধরণের ঘটনা দ্বারা যদি আমাদের স্বাভাবিক জীবনে কোনো বিপদ বা আপদ হবার সম্ভাবনা থাকলে তাকে বিপর্যয় বলে। এই ধরণের বিপর্যয়ের ফলে কোন কোন এলাকার মানুষের স্বাভাবিক জীবনের ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
দুর্যোগঃ দুর্যোগ হলো এমন সব ঘটনা যেসব ঘটনার ফলে কোনো নির্দিষ্ট এলাকার মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় যা মোকাবিলা বা প্রতিরোধ করা সাধারণ মানুষের আয়ত্ত্বের বাইরে চলে যায়।
দুর্যোগ এমন এক ধরণের প্রাকৃতিক বা মানুষের সৃষ্ট ঘটনা যা কোনো কোনো এলাকাকে সম্পূর্ণ ধ্বংশ করে দেয়।
আমরা পৃথিবীর যে দেশেই যাই না কেন দেখতে পাবো সকল দেশেই দুই ধরণের দুর্যোগ ঘটে থাকে।
১) প্রাকৃতিক দুযোগ
২) মানুষ-সৃষ্ট দুর্যোগ
প্রাকৃতিক দুর্যোগঃ
যে দুর্যোগের ফলে কোনো নির্দিষ্ট লোকালয়ে বসবাসরত সাধারণ মানুষের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি ও বাড়ি-ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং যে দুর্যোগে ঘটার সাথে মানুষের কোনো হাত থাকে না, তাকেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলে। যেমনঃ বন্যা, খরা, ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড়,টর্নেডো ইত্যাদি।
মানুষ সৃষ্ট দুর্যোগঃ
প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াও এমন কিছু দুর্যোগ আছে, যেগুলো ঘটার পিছনে কোনো বা কোনো ভাবে মানুষ জড়িত থাকে। সেসব দুর্যোগই হলো মানুষসৃষ্ট দুর্যোগ। পূর্বে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতো কিন্তু বর্তমানে মানুষসৃষ্ট দুর্যোগের প্রভাবে মানুষ ও প্রকৃতি উভয়ই ক্ষতির সম্মুক্ষিন হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতির পরিমানঃ গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ বেশ কয়েকটি ভয়ংকর প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়েছিলো। এসব দুর্যোগের ফলে বহু মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে এবং আর্থিক ক্ষতিতে পড়ে। ঘরবাড়ি ধ্বংশ, ফসলের ক্ষেতের ফসল নষ্ট, মানুষ মারা যাওয়া, বিদ্যৎ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্থ সহ আরো নানা ধরণের ক্ষতির শিকার হয়।
২০১৭ সালে বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবে বলা হয়েছে,” বাংলাদেশ হচ্ছে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা,ভূমিকম্প ও খরা প্রবণ দেশ।”
২০১৭ সালে বৈশ্বিক জলবায়ূ পরিবর্তন ঝুঁকিসূচক অনুযায়ী,” জলবায়ূ ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান পৃথিবীতে ষষ্ঠ। বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশে প্রতিবছর ৩২০ কোটি ডলার বা ২৫,৬০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। যা দেশের জিডিপির ২ দশমিক ২ শতাংশ।”
২৮ শে অক্টোবর ২০২১ এ জাগো নিউজ ২৪ এর একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে,” ২০২০ সালে বাংলাদেশে দুর্যোগের ফলে আর্থিক ক্ষতি প্রায় ১১৩০ কোটি মার্কিন ডলার যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৯৬ হাজার ৯৪৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকারও বেশি।”
এভাবেই প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারনে বাংলাদেশ আর্থিক ক্ষতি সহ নানাবিধ ক্ষতির সম্মুক্ষিন হচ্ছে।
বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ধরণঃ
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশে প্রায় ৩ ধরণের প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা যায়। যথাঃ
- বায়ূমণ্ডলীয় দুর্যোগঃ এই ধরণের প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে রয়েছে কালবৈশাখী, ঝড়, ঘূর্ণিঝড়,হারিকেন, টর্নেডো, খরা ইত্যাদি।
- ভূ-পৃষ্ঠে সং ঘটিত দুর্যোগঃ বন্যা, ভূমিধস, নদীভাঙ্গন, ভূ-অভ্যন্তরস্থ পানিদূষণ প্রভৃতি ভূ-পৃষ্ঠে সংঘটিত হয়।
- ভূ-গর্ভস্থ দুর্যোগঃ এ ধরণের দুর্যোগ গুলো ভূমির অভ্যন্তরে সংঘটিত হয়। যেগুলো সম্পর্কে পূর্ব থেকে কোনো ধারণা পাওয়া যায় না। যেমন- ভূমিকম্প ও অগ্ন্যুৎপাত।
বাংলাদেশের বন্যা:
প্রতিবছরই বাংলাদেশকে নানা রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবিলা করতে হয়। বাংলাদেশে প্রতিবছর ঘটে থাকে এমন কয়েকটি প্রধান প্রাকৃতিক দুর্যোগ গুলো হলোঃ
বন্যাঃ ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশের অন্যতম একটি ঋতু হলো বর্ষা। আষাঢ়-শ্রাবণ এই দুইমাস মিলে আসে বর্ষা ঋতু, বাংলার প্রকৃতিকে নতুন করে সাজাতে। বাংলাদেশের গ্রাম বাংলায় বর্ষা মানেই হলো বৃষ্টি। সময় নেই, ক্ষণ নেই, নিমন্ত্রণ নেই, বৃষ্টি চলে আসে যখন-তখন। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। এই বৃষ্টি যখন অতিরিক্ত মাত্রা ধারণ করে খাল-বিল ভরাট হয়ে যায়, তখন তার পরিবর্তিত রূপের নাম হয় বন্যা।
সাধারণত বর্ষা কালে অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে খাল-বিল, নদী-নালা সব ভরাট হয়ে পানি লোকালয়ে ঢুকে পড়ে। তখন একে বন্যা বলে। মে মাস থেকে শুরু হয়ে নভেম্বর মাস পর্যন্ত বাংলাদেশে বন্যা ভয়ংকর রুপে দেখা দেয়। গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে ভয়ংকর ও ধ্বংসাত্মক রূপে ৫ টি বন্যা হয়েছে। সালের বন্যায় বাংলাদেশ প্রচুর ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ১৯৫৫,১৯৬৩, ১৯৭৪, ১৯৮৭, ১৯৮৮,১৯৯৮, ২০০০,২০০৪ ও ২০০৭ সালের বন্যা।তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছিলো ১৯৯৮ সালের বন্যায়।
বাংলাদেশে বন্যার ধরণঃ
প্রতি বছরই বাংলাদেশে কম-বেশি বন্যা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে প্রধানত চার ধরণের বন্যা হয়ে থাকে।
১) আকস্মিক বন্যাঃ এপ্রিল-মে, সেপ্টেম্বর- নভেম্বর মাসে স্বল্পস্থায়ী ভারী বর্ষণের কারণে পাহাড়ি নদীর পানি উপচে পড়ার ফলে পাহাড়ের পাদদেশে যে বন্যার সৃষ্টি হয়, তাকে আকস্মিক বন্যা বলে। দেশের সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি আকস্মিক বন্যায় কবলিত এলাকা।
এদেশে ২০০২, ২০০৪, ২০০৭, ২০০৯ ও ২০১০ সালের আকস্মিক বন্যায় উত্তর-পূর্ব হাওড় অঞ্চলে শীতকালীন ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়।
২) নদীসৃষ্ট বন্যাঃ জুন ও জুলাই মাসে বর্ষা মৌসুমের শুরুতে ব্রহ্মপুত্র নদীখাতে সর্বোচ্চ প্রবাহ সৃষ্টি হয়। আগস্ট- সেপ্টেম্বরে গঙ্গার পানি সর্বোচ্চ প্রবাহ হয় এবং বন্যার সৃষ্টি হয়।
৩) বৃষ্টিজনিত বন্যাঃ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বৃষ্টিজনিত বন্যা বেশি হয়। ২০১৪ সালের জুন মাসে ভারি বর্ষণের কারণে চট্টগ্রামে ভয়াবহ বন্যা হয়।
৪) উপকূলীয় বন্যাঃ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূল রেখা( প্রায় ৮০০ কিলোমিটার) সংলগ্ন এলাকাতে উপকূলীয় বন্যা দেখা দেয়। বঙ্গোপসাগরের অগভীর মহাসোপান, বঙ্গোপসাগরে পূর্ব অংশের ফানেল ও মোচাকৃতির উপকূল রেখার কারণে ঘূর্ণিঝড়ের উচ্চতা (১০-১৫) মিটারের অধিক হলে উপকূলীয় অঞ্চলে বন্যা হয়। ১৯৭০ সালের ১২ ই নভেম্বর, ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল, ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ভয়াবহ বন্যা হয়।
বন্যা কেন হয়?
বন্যা যেহেতু একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, তাই আমরা বলতে পারি, প্রাকৃতিক কারণেই বন্যা হয়ে থাকে। তবে বন্যার কিছু মানুষসৃষ্ট কারণও রয়েছে। বন্যার কারণ সমূহকে আমরা দুই ভাগে ভাগ করতে পারি।
বন্যার প্রাকৃতিক কারণঃ
- বর্ষাকালে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে নদীর উজানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। এই প্রচুর বৃষ্টিপাতই বন্যার একটি কারণ।
- হিমালয়ের বরফ গলে পানিপ্রবাহ নদীর অভিমুখে চলে আসে। যার ফলে নদীর পানি বৃদ্ধি পায়। এতে বন্যা সৃষ্টি হয়।
- মৌসুমি বায়ুর প্রভাবেও বন্যা হয়ে থাকে।
- নদীসমূহের গভীরতা হ্রাস পাওয়া
- বঙ্গোপসাগরে ভরা জোয়ারের পানি বেড়ে গিয়ে বন্যা হতে পারে।
বন্যার মানবসৃষ্ট কারণঃ
- গঙ্গা নদীর উপর নির্মিত ফারাক্কা বাধ ও তিস্তা নদীর উপর নির্মিত বাধের প্রভাবে বন্যা হয়ে থাকে।
- বালু ভরাট ও উত্তোলনের কারণে নদী সমূহের স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা পেয়ে বন্যার সৃষ্টি হয়।
- শহরাঞ্চলে নগরায়নের ফলে জলাধার ও খাল সমূহ ভরাট করার কারণে পানি চলাচলে বাধা পায় এবং জলাবদ্ধতার কারণে বন্যা হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের ভয়াবহ বন্যাঃ
১৯৮৭ সালের বন্যাঃ
১৯৮৭ সালের জুলাই-আগস্ট মাসের বন্যায় বাংলাদেশে নেমে আসে ধ্বংশের মাতম। বাংলাদেশ প্রচুর ক্ষতির শিকার হয়। প্রায় ৪০% এর বেশি এলাকা প্লাবিত হয়। যা প্রায় ৫৭ হাজার ৩০০ বর্গকিলোমিটার এলাকার সমান। এই ধরণের বন্যা ৩০-৭০ বছরে একবার হয়।
১৯৮৮ সালের বন্যা
প্রতি বছরে বন্যায় বাংলাদেশে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। এ যাবতকালে বাংলাদেশে সবচে প্রলয়ংকারী বন্যা গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ১৯৮৮ সালের বন্যা। ১৯৮৮ সালের বন্যার কথা স্মরণ হলে আজও মানুষ কেঁপে ওঠে। স্মরণকালের সেই ভয়াবহ বন্যায় দেশের প্রায় ৬০% এলাকা ডুবে গিয়েছিলো। আগস্ট – সেপ্টেম্বর মাসে সংঘটিত সেই বন্যায় ১৫-২০ দিন দেশের বিভিন্ন জায়গায় টানা বৃষ্টি হয়েছিলো। সেই সময় ভয়ংকর বন্যায় মাত্র ৩ দিনেই দেশের প্রধান ৩ টি নদীর পানি ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত পানি প্রবাহিত হয় এবং বন্যা তীব্র আকার ধারণ করে। এই সময় বন্যার পানি ১২২ মিটার বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এই বন্যার কারণে দেশের প্রায় ৮২ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২৩ শে আগস্ট পর্যন্ত ১২১ জন মারা যায়। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ রেলপথ মেরামতে প্রায় ৪০ কোটির মতো খরচ হয়েছিলো। রাজধানী ঢাকায় বসবাসরত প্রায় ৫০ লাখ মানুষ ঘরবন্দী হয়ে পড়েছিলো। কয়েক হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত আর্থিক ক্ষতি হয়েছিলো।
১৯৯৮ সালের বন্যাঃ বাংলাদেশে সংঘটিত ভয়াবহ ও ভয়ংকর বন্যা সমূহের মধ্যে অন্যতম হলো ১৯৯৮ সালের বন্যা। এই বন্যা প্রায় দুই মাস স্থায়ী ছিলো। প্রায় দুই তৃতীয়াংশ এলাকা ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
সেই সময় সারা দেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়।বৃষ্টিপাতের ফলে মাত্র ৩ দিনেই প্রধান ৩টি নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে একই সময়ে প্রবাহিত হয়। যা পরবর্তীতে ভয়ংকর ও ভয়াবহ বন্যায় রূপ নেয়।
১৯৯৮ সালের বন্যা ১০০ বছরের মধ্যে সবচে ভয়াবহ। বন্যায় বিপদসীমার ৬৮ মিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়ে বন্যার সৃষ্টি করে। এতে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। বাংলাদেশের প্রায় ৬৪ টি জেলার মধ্যে ৫২ টি জেলা এই বন্যার ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। দেশের অসংখ্য মানুষ বন্যার ফলে গৃহবন্দী হয়ে পড়ে। ১২ কোটি মানুষের মধ্যে ৩ কোটি মানুষ বন্যার কারণে মানবেতর জীবন যাপন করে। প্রায় ৬৫ হাজার হেক্টর জমি পানিতে ডুবে ছিলো দীর্ঘদিন। খাদ্য ঘাটতি ছিলো প্রায় ২১৮ লাখ মেট্রিক টন। সেই সময় ১৫০০ মানুষ মারা যায়। এই বন্যা ৮০ দিনের মতো স্থায়ী ছিলো।
২০০০ সালের বন্যাঃ আজ থেকে ২০-২২ বছর আগের কথা। ২০০০ সালের আগস্ট- সেপ্টেম্বর মাসের এক আকস্মিক বন্যায় বাংলাদেশের ক্ষতির পরিমাণ ছিলো অপরিমেয়। সেই বন্যায় বাংলাদেশের দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের ৭টি এবং দক্ষিনের ২ টি জেলার প্রায় ৪১ টি উপজেলার ২৮০ টি ইউনিয়নে বন্যায় ৩০ লাখ মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ৮ লাখের বেশি মানুষ ঘরবাড়ি হারায়।
২০০৭ সালের বন্যাঃ ২০০৭ সালকে বলা যায় দুর্যোগের বছর। এই বছর একই সাথে কয়েকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেয়। বন্যা, খরা, নদী-ভাঙ্গন, ভূমিধস, অতিবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস- প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ। সারা বছর জুড়েই একের পর এক দুর্যোগকে সামাল দিতে হয়েছে দেশবাসীকে। দুর্যোগের ঘনঘটা ছেয়ে গেছে গোটা দেশ।
২০০৭ বছরের প্রথমেই জানুয়ারি মাসে খরার কবলে পড়ে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল সহ কয়েকটি এলাকা। জুলাইতে প্রথম ধাপের বন্যা। সেপ্টেম্বরে আকস্মিক অস্বাভাবিক বন্যা। সেই সাথে দেখা দেয় নদীভাঙ্গন। পরপর দুইবারের বন্যায় প্রায় ১৪ লাখ টন ফসল খাদ্যশষ্য নষ্ট হয়। যার ফলে খাদ্যঘাটতি দেখা দেয় প্রায় ১৯ লাখ টন।
অতিবৃষ্টি বরাবরই পাহাড়ি এলাকার জন্য আতঙ্কের কারণ। সেবার মানে ২০০৭ সালের জুন মাসে হঠাৎ অতিবৃষ্টি শুরু হয়। চট্টগ্রাম ও আশেপাশে পাহাড় ধসে পড়ে। পাহাড়ধস ও পাহাড় চাপায় ১২৭ জন মারা যায়।
তবুও দুর্যোগ ছাড়ে নি দেশের মানুষকে। ২০০৭ এর ১৫ ই নভেম্বর দেশের ইতিহাসে একটি ভয়ংকর দুর্যোগের দিন। এই দিন দেশের দক্ষিণ উপকূলে আঘাত হানে প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় সিডর। সিডরের ভয়াবহতা বর্ণনা করার মতো নয়। এতে দেশের ৩২ জেলার প্রায় ২০ লাখ মানুষ ক্ষতির সম্মুক্ষিন হয়। সিডরে প্রায় ১৫ হাজার লোক মারা যায়। বিশেষজ্ঞের মতে,” গত ১৩১ বছরের ইতিহাসে এটি অন্যতম।”
২০১৪ সালের বন্যাঃ উত্তর-পূর্ব ও উত্তর- পশ্চিমাঞ্চলের ১৪ টি জেলায় ২০১৪ সালের ১৩ ই আগস্ট থেকে বন্যার কবলিত হয়। এই বন্যাও বাংলাদেশের একটি ভয়াবহ বন্যায় পরিণত হয়। অতিরিক্ত বর্ষন, জোয়ারের পানি ও পাহাড়ী ঢল এই বন্যার কারণ। এছাড়া প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে ফারাক্কা বাঁধ খুলে দেওয়ার কারণে বন্যা হয়ে থাকে। নীলফামারি, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, নেত্রকোনা, ফরিদপুর, রাজবাড়ি, বগুড়া, সিলেট সহ অন্যান্য জেলায় প্রবল বর্ষনের ফলে বন্যায় কবলিত হয়। প্রায় ৮৪২৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সমগ্র বাংলাদেশের ১৮ টি জেলার ২.১৫ মানুষের ঘরবাড়ি, বসতবাড়ি, আবাদি জমি, জীবন-জীবিকা এবং ফসলের ক্ষতি হয়। এই বছরের বন্যায় প্রায় ২১ জন মানুষ মারা যায়।
কোন কোন জেলায় বন্যা বেশি হয়?
ভৌগোলিক অবস্থান ও জলবায়ু পরিবর্তন-এই দুই কারনে বাংলাদেশে বন্যা বেশি হয়। তবে সব জেলায় হয় না। কোনো কোনো জেলায় অতিরিক্ত বন্যার কবলে জনজীবন হুমকির সম্মুক্ষিন হয়। আষাঢ় থেকে আশ্বিন এই মাসগুলোতে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল, মধ্যাঞ্চল, দক্ষিণাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় যেমন সুনামগঞ্জ, বরগুনা, পিরোজপুর, মাদারীপুর, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, বাগেরহাট, নেত্রকোনা, নিলফামারী, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, রাজবাড়ি, সিলেট, দিনাজপুর, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, টাঙ্গাইল, মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর সহ আরো অনেক।
বন্যায় মোকাবিলায় করণীয়ঃ
পূর্ব প্রস্তুতিঃ আমরা দেখেছি যে, বন্যা হলে আমাদের দেশ প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সমুক্ষিন হয়। এসব ক্ষতি এড়ানো সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা যদি বন্যা মোকাবিলা করার জন্য কিছু পূর্বপ্রস্তুতি নিতে পারি, তবে পুরোপুরি না হলেও কিছুটা ক্ষতি আমরা এড়াতে পারি।
বন্যার পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে যেসব কাজে আমাদের গুরুত্ব দেওয়া দরকারঃ
- সবসময় আবহাওয়ার সংবাদ শোনা।
- যেদিন থেকে বন্যার পূর্বাভাস পাওয়া যাবে, সেদিন থেকেই বন্যা মোকাবিলা ও ক্ষয়ক্ষতি কমাতে প্রস্তুতি নিতে হবে।
- শুকনো খাবার ও খাবার পানি আলাদা করে সংরক্ষণ করতে হবে।
- বাড়িতে কার্বলিক এসিড মজুদ রাখা যাতে করে সাপের উপদ্রব থেকে বাঁচা যায়।
- গবাদিপশু যেমন- গরু-ছাগল ও হাস-মুরগির জন্য উঁচু করে মাচা তৈরি করা।
- বন্যা প্রতিরোধী শস্য রোপন করা অর্থাৎ যেসব ফসল বন্যার পানিতেও টিকে থাকতে পারে সেগুলো রোপন করা।
- শোবার খাট ও বাড়ির চারপাশে সম্ভব হলে বেষ্টনি দেওয়া। যাতে ছোট বাচ্চারা পানিতে না পড়ে।
- বন্যার সময় চলাচলের জন্য নৌকা তৈরি করা।
- বাড়ির ভিটা উঁচু করা
- শিশুদের সাঁতার শেখানো
- নিরাপদ অথবা বিকল্প আশ্রয় কেন্দ্রের খোঁজ রাখা।
বন্যা কালীন প্রস্তুতিঃ
- বন্যা কালীন সময়ে কাছাকাছি উঁচু স্থান বা নিকট কোনো আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিতে হবে।
- নিজের বসতবাড়িতে থাকা সম্ভব না হলে নিকটবর্তী কোনো জায়গায় বা আশ্রয় কেন্দ্রে থাকা।
- প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ঘরের চালের নিচে পাটাতনে রাখা।
- টিউবওয়েলের পানি পান করুন। টিউবওয়েলের পানি না থাকলে ফুটিয়ে পানি পান করুন।
- শুকনো খাবার সংরক্ষণ করুন
বন্যাকালীন নারীদের করণীয়ঃ
- দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে আগে থেকেই অর্থ সঞ্চয় করুন।
- আলগা চুলা ও জ্বালানী জোগাড় করে রাখুন।
- গর্ভবতী নারীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় ঠিক করে রাখুন। এলাকার ধাই ও স্বাস্থ্যকর্মীর সাথে যোগাযোগ রাখুন। নিরাপদে সন্তান প্রসবের জন্য বাড়িতে সব উপকরণের ব্যবস্থা রাখুন।
বন্যাকালীন রোগব্যাধি থেকে বাঁচার উপায়ঃ
- বন্যার পানি ফুটিয়ে পান করুন
- খাবার ঢেকে রাখুন
- পঁচা-বাসী খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। এতে ডায়রিয়া হতে পারে।
- খাবার আগে ও টয়লেট ব্যহারের পর সাবান বা ছাই দিয়ে ভালো করে হাত ধুতে হবে।
- পাতলা পায়খানা বা ডায়রিয়া হলে স্যালাইন পান করতে হবে।
বন্যা পরবর্তী করণীয়ঃ
- বন্যার পানি নেমে গেলে নিজ বাড়িতে গিয়ে বাড়িঘর পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন ও মেরামত করুন
- বাড়ির আশেপাশে শাকসব্জির চাষাবাদ করা শুরু করা যায়
- বন্যার পর পানিবাহিত রোগবালা দেখা যায়। এসব থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য বিশুদ্ধ পানি পান ও ব্যবহার করতে হবে।
- পানি পানের আগে ফুটিয়ে নিতে হবে।
- ঘরবাড়ি মেরামত বা পূনঃনির্মাণের জন্য স্বেচ্ছাসেবক দলের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।
- পানি বাহিত রোগ প্রতিরোধে টিকা গ্রহণ আবশ্যক
- সবসময় স্বেচ্ছাসেবক দলের সাথে যোগাযোগ রাখতে হবে।
- নিজেকে ও পরিবারের সদস্যদের প্রতি খেয়াল ও যত্ন নিতে হবে।
- পুকুর ডোবায় পানি কমে গেলে মাছ সংগ্রহ ও পরবর্তীতে মাছ চাষের ব্যবস্থা করা।
বন্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাঃ
যদিও বন্যা এক প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ। একে নিয়ন্ত্রন করা সহজ নয়। তবুও এমন কিছু পদক্ষেপ আছে যেগুলো গ্রহণের মাধ্যমে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা কিছুটা হলেও সম্ভব।
বন্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথাঃ
১) সাধারণ ব্যবস্থাপনাঃ নদীর দুই তীরে বৃক্ষ রোপন করা, নদী শাসন ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা, বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন করা ইত্যাদি।
২) ব্যয় বহুল প্রকৌশলগত ব্যবস্থাঃ ড্রেজিং এর মাধ্যমে নদীর পরিবহন ক্ষমতা বৃদ্ধি করা, জলাধার নির্মাণের মাধ্যমে পানি প্রবাহকে সম্পূর্ণ রূপে নিয়ন্ত্রণ করা, সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকার পানির অনুপ্রবেশ বন্ধ করা।
৩) সহজ প্রকৌশলগত ব্যবস্থা গ্রহণঃ নদীর দুই তীরে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা, বনায়ন সৃষ্টি করা, পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখা।
শেষ কথাঃ
একবিংশ শতাব্দিতে বাস করছি আমরা। প্রতিনিয়ত ডিজিটাল প্রযুক্তির সঙ্গে আমাদের বসবাস। তথ্য সংগ্রহতে নেই কোনো বিরাম। আবহাওয়ার সংবাদ পেয়ে যাচ্ছি সেকেন্ডেই। তাই আগাম প্রস্তুতি নিতেও নেই কোনো কার্পন্য। সুতরাং আমরা যদি ব্যক্তিগত ও সামাজিক ভাবে সচেতন হতে পারি, তাহলে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি থেকে নিজেদের অনেকাংশে রক্ষা করতে পারি। আমরা যারা বন্যা কবলিত এলাকা থেকে দূরে আছি, তারা যেন বন্যা কবলিতদের সাহায্য- সহযোগীতার মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি কাটাতে তাদের পাশে থাকতে পারি।