মহামারী সংকলন-৪ (খ্রিস্টাব্দ ২৫০-২৭১ সাইপ্রিয়ান প্লেগ মহামারী)
সাইপ্রিয়ান প্লেগ মহামারীটি ২৫০ খ্রিষ্টাব্দে ইথিওপিয়ার পূর্বাঞ্চলে বিস্তার শুরু করে। এক বছর পর এটি ধীরে ধীরে রোমে ছড়িয়ে পরে, এরপর গ্রীসে এবং এরপর আরও পূর্বের দিকে সিরিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। সাইপ্রিয়ান প্লেগ মহামারীটি ২০ বছর যাবৎ স্থায়ী ছিল এবং এটি এর সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়ে রোমে দৈনিক ৫০০০ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছিল।
যুদ্ধের কারণে সীমান্ত একের পর এক হামলা হওয়ার রোম সাম্রাজ্যের নাগরিকেরা দ্রুত প্লেগে আক্রান্ত হতে থাকেন। জার্মানির উপজাতি গাউল এবং পার্থিয়ানরা মেসোপটেমিয়ায় আক্রমণ করেছিল। সম্রাটদের কাজ সম্পাদন হয়ে পড়েছিল অশান্তির ও কঠিন। কারণ খরা, বন্যা এবং দুর্ভিক্ষের জন্য জনপদ দুর্বল ও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। কার্টেজের বিশপ সেন্ট সাইপ্রিয়ান মন্তব্য করেছিলেন, “ পৃথিবী শেষের দিকে এমন মনে হয়েছিল।”
সাইপ্রিয়ান প্লেগের নামকরণ করা হয় সাইপ্রিয়ানের নাম অনুসারে যিনি প্রথম এই মহামারীর অসুস্থতার পর্যবেক্ষণ করেন এবং রোগের প্রাথমিক ধারণা সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে পরিচিত করিয়েছিলেন । তিনি মহামারী সম্বন্ধে বিশদ বিবরণ লেখেন তার লেখনী “On Mortality”তে ।
আক্রান্ত রোগীরা ডায়রিয়া, অনর্গল বমি, জ্বর , বধিরতা , অন্ধত্ব , পা এবং পায়ের পাতা অচল ও অনুভূতি শুন্য হয়ে যাওয়া , গলা ফোলা এবং রক্তাক্ত চোখ মুখ – এ জাতীয় লক্ষণের সম্মুখীন হতেন। বেশির ভাগ সময়ই রোগী মারা যেতেন। পৌত্তলিকরা ধারনা করেছিলেন দেবতারা শাস্তি হিসেবে এই ভয়াবহ দুর্দশার মানবজাতিকে দিয়েছেন। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল জুড়ে যেভাবে রোগটি ছড়িয়ে পড়েছিল তাতে করে প্রাক-খ্রিস্টান সংস্কৃতি অনুসারে অতিপ্রাকৃতিক কিছু বলে দাবি করা হতো রোগটিকে।
পরে যদিও পন্ডিত ও ঐতিহাসিকেরা ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। প্রাচীন সময়ে রোগ শনাক্তকরণ এবং তার চিকিৎসা করা বরাবরই কঠিন কাজ ছিল কারণ তখনকার প্রযুক্তি এত উন্নত ছিল না এবং তাদের এ ব্যাপারে জ্ঞান ও উপলব্ধির পরিসরও ছিল ছোট। জীবিতদের সংখ্যা খুবই কম ছিল। এর ভিত্তিতে বলা হয়েছে, প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ যোগাযোগের মাধ্যমে রোগ টি ছড়াতো। এমনকি পোশাকের মাধ্যমেও সংক্রমিত হতো। শতাব্দীর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পন্ডিতেরা এই রোগের নানান রকম পরামর্শ দিয়েছিলেন।
প্লেগ রোগের উৎপত্তি কোথায়: মহামারী সংকলন-1
মহামারী সংকলন-১ চীনের প্রাগৈতিহাসিক মহামারী
মহামারী সংকলন-২ খৃষ্টপূর্ব ৪৩০ এর এথেন্সের প্লেগ মহামারী
মহামারী সংকলন-৩ খ্রিস্টাব্দ ১৬৫-১৮০ এর অ্যান্টোনিন প্লেগ মহামারী
মহামারী সংকলন- ৫ (খ্রিস্টাব্দ ৫৪১-৫৪৯ জাস্টিনিয়ার প্লেগ মহামারী)
খৃস্টাব্দের তৃতীয় শতাব্দীতে বুবোনিক প্লেগ, টাইফাস, কলেরা, গুটি, হাম এবং অ্যানথ্রাক্সের জন্য সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যায়। নির্দিষ্ট কোনো লক্ষণ না থাকায় প্রাথমিকভাবে সন্দেহভাজনদের দূরে রাখা হতো। আক্রান্তদের শরীর ফুলে যাওয়া বা অন্য কোনো লক্ষণ উল্লেখ তো হয়নি প্লেগের লক্ষণে। বিভিন্ন রোগের লক্ষণ একসাথে হয়ে দেখা দিত , যেমন তীব্র কলেরা এবং ম্যানিনজাইটিস। কাইল হপীর্স তার লেখনী “ Pandemics and Passages to Late Antiquity” তে বলেছেন, এই হেমোরজিক জ্বর সম্ভবত ইবোলা ছিল।
এই মহামারীর ছড়িয়ে পড়া সম্বন্ধে প্রথম তথ্য দেন ইতালীর প্রত্নতাত্ত্বিকেরা ২০১৪ সালে। লাক্সারের হারওয়ার ফিউনারারি কমপ্লেক্স থেকে তারা কিছু লাশ পেয়ে ছিলেন। সেগুলোর গায়ে চুন মেখে আগুনে পুড়িয়ে দিয়ে মহামারী থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করা হয়ে ছিল। ডিএনএ পরীক্ষার পর তারা প্রমান পেয়েছিলেন ১৮০০ বছর আগে রোমান সাম্রাজ্য ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য , কিছু মহামারী কারণ ছিল। তবে তারা কোনো শেষ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেন নি।
এই মহামারীর কারণে ২০০ শতকের মাঝামাঝিতে রাজনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় উত্থান হয়েছিল। রোম ও তার আশেপাশে দৈনিক হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছিলো ।যার প্রকোপ ২ জন সম্রাটের জীবন কেড়ে নেয়। ২৫১ সালে হিস্টোলিয়ান ও ২৭০ সালে ক্লোডিয়াস দ্বিতীয় গথিকাসের। এবং এর মধ্যবর্তী সময় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সম্মুখীন হয়েছিল। প্রতিদ্বন্দীরা সিংহাসন দাবী করছিল এবং ধরে রাখতে লড়াই করছিল।
নেতৃত্বের অভাবে রোমান সৈন্যরা দূর্বল হয়ে পড়ে এবং শহরের বাসিন্দারা পালাতে শুরু করে ও শহর গুলো ফাঁকা হতে শুরু কবে। কৃষকদের মৃত্যু হতে শুরু করলে তারা ফসল ফলানো বন্ধ করে দেয়।এ ভাবে ধীরে ধীরে রোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। এ জাতীয় বিশৃঙখলায় শুধু মাত্র নতুন ধর্ম খৃষ্টান ও এই ধর্মাবলম্বীরা উপকৃত হয়। পরবর্তীতে তারা রোগীদের সেবা করতেন এবং তাদের অনেকেই আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং মৃত্যু বরণ ও করতে তবে তারা এটাকে শহীদ হওয়া বলতেন। এভাবেই ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে খ্রিষ্টান ধর্ম ছড়িয়ে পড়ে।
অসচেতনতাই কিন্তু যেকোনো মহামারী ছড়ানোর প্রধান কারণ। ঘন জনবসতি পূর্ন এলাকায় খুব সহজেই মহামারী ছড়িয়ে পড়ে। আমরা কোনো একটা পরিস্থিতি তৈরী হলে শুরুতেই সচেতন হই না। অনেক জীবনের ক্ষতির পর আমরা বুঝতে শুরু করি যে এবার আমাদের সচেতন হতে হবে।
More Stories
পুন্ড্রবর্ধন: ঐতিহাসিক রহস্যের এক অধ্যায়
চন্দ্রবোড়া সাপ কামড়ালে কি করা উচিত
সাপ্তাহিক চাকরির খবর ২০২৪