একটি পতাকা
রায়হানুল ইসলাম শাকিল
রানু স্কুল শেষে বাসায় ফিরে সারা বাড়ি হোন্নে হয়ে খুঁজেও মাকে না পেয়ে ভ্যাবলাইকে নিয়ে কাঁঠাল তলায় বসে আছে।ভ্যাবলাই কে তার খুব পছন্দ।মন খারাপ হলেই সে ভ্যাবলাই এর সাথে গল্প করে।আজ তার সাথে গল্প করতেও রানুর ভাল লাগছে না। একে তো চৈত্র মাসের কাঠ ফাটা রোদ তার সাথে যোগ হয়েছে ভয়ঙ্কর রকমের ক্ষুধা।ভ্যাবলাই তার ভাগের দুধ সাবাড় করে উদর পূর্তি করে বসে আছে।হঠাৎ মার গলার আওয়াজ পেয়ে রানু দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় নালিশ করল।কোথায় ছিলে?ভাত দাও।
রানু হাত ধুয়ে খেতে বসল। মাছের কাটা গুলো ভ্যাবলাইয়ের দিকে ছুড়ে দিয়ে সে হাত ধুয়ে শুয়ে পড়ল।খুব ক্লান্ত লাগছে তার তবুও সে ঠিক করেছে ঘুমাবেনা।বিকেলে রহিমাদের উঠোনে পুতুল খেলতে যেতে হবে যে তার।কিন্তু সে ইচ্ছে পূরণ হল না।ক্খন যে চোখ দুটো হাল ছেড়ে দিয়েছে সে বুঝতেই পারেনি।ভ্যাবলাই এর মিউ মিউ আওয়াজে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল।ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই তার মনটা খারাপ হয়ে গেল।যদিও সে এই তিন কাটার খেলা খুব একটা বোঝেনা কিন্তু কাটা গুলোর অবস্থান দেখে সময় আন্দাজ করতে পারে।
সে নিজের ভাষায় ভ্যাবলাই কে আচ্ছা মত বকে দিল। কেন তাকে আগে ডেকে দেয়নি।চোখ মুছতে মুছতে সে মার পাশে গিয়ে বসল।আজান শেষ হল,দূরে কোথাও শাঁক বেজে উঠল।ও তার সন্ধ্যে বেলায় খাওয়ার অভ্যাস টা ঠিক রেখে পড়তে বসেছে।ওদের বাংলার মাস্টারমশায় বেশ কড়া মানুষ। পূর্বে মাস্টারমশায়ের ভয়ে পড়তে বসলেও এখন বাংলা গল্প গুলো পড়তে তার বেশ ভাল লাগে।মাস্টারমশায়কেও এখন খুব ভাল লাগে রানুর।কত কিছুই না শিখেছে তাঁর কাছে।পড়া শেষ করে সে মায়ের আঁচলের ফাঁকে মুখ গুজে দিয়ে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে বাবার কথা ভাবছে।
বাবা থাকতে সে বাবার কাছে ঘুমাত। বাবার কাছে গল্প শুনত।কখনও রূপকথার গল্প,কখনও ভূতের গল্প আবার কখনও শুনত নতুন ধরনের গল্প যেমন ভাষা আন্দোলনের গল্প,মুক্তি সংগ্রামের গল্প।এই নতুন ধরনের গল্পের জটিলতা তার সরল মস্তিককে স্পর্শ করতে ব্যর্থ হলেও তার কোমল হৃদয়কে ঠিকই স্পর্শ করত।কে জানে,হয়ত ছোট্ট রানুর মনে মুক্তির বীজ বপণের আশায় তার বাবা তাকে গল্প গুলো শুনাত।ছয় মাস হল রানুর বাবা জেলে।স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নেওয়ায় স্বৈরাচারী শাসকের পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে গেছে।পরদিন খুব ভোরে রানুর ঘুম ভেঙ্গেছে।
সে উঠানে একা একা বসে আকাশ দেখছে।আসন্ন কাল বৈশাখীর মেঘে আকাশটা কাল হয়ে এসেছে।মেঘগুলোর কাছে দিনের সূর্য্টা হার মেনে গেছে।রানু কোথাও সূর্য মামাকে দেখতে পেল না।মনে হচ্ছে যেন দিনকে রাতের আধাঁর গ্রাস করে নিয়েছে।হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের আলোয় চারিদিক আলোকিত হয়ে এলো।দূরে কোথাও যেন আকাশটা ভেঙ্গে পড়ল।রানু ভয়ে উঠান থেকে এক দৌড়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেল।কিছুক্ষণের মধ্যেই মুশুলধারে বৃষ্টি শুরু হল। রানুর উঠানে যেতে ভয় করছে।কিন্তু তার বৃষ্টি দেখতে খুব ভাল লাগে।
হঠাৎ কোথা থেকে যেন ভ্যাবলাই এসে মিউ মিউ আওয়াজ করে তার গায়ে গা ঘেষতে লাগল।রানুর সাহস হল,সে ভ্যাবলাই কে সঙ্গী করে উঠানে গিয়ে বসল।ঝড়ো বাতাসে বয়ে আসা মৃদু বৃষ্টির ঝাপটা তার ভালই লাগছে।ঝড়ো বাতাসে লম্বা লম্বা গাছ গুলো যেন একই তালে নৃত্য করছে।নীলুদের বাড়ির পাশের সুপারি গাছটা দেখে মনে হচ্ছে যেন এখনি ভেঙ্গে পড়বে।চোখের কোনে কিছু একটার নড়াচড়া তার দৃষ্টিটাকে গাছের মগডাল থেকে সোজা মাটিতে নিয়ে আসল।কয়েকটা কুনোব্যাঙ বৃষ্টির ছোঁয়ায় আনন্দে মেতেছে।একত্রে গলা ফাটিয়ে গান গাইছে।দূরে ক’জন ছেলে মেয়ে বৃষ্টিতে গোসল করছে।রানুর ও খুব ভিজতে ইচ্ছে করছে কিন্তু গতবার স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে বৃষ্টিতে ভিজে কি আসুখটাই না বাধিয়েছিল তা সে ভোলেনি।
তিন দিন জ্বরে বিছানা থেকে উঠতে পারেনি।বৃষ্টি থামার কোন নাম নেই। আজ তার আর স্কুলে যাওয়া হবেনা ভেবে তার মনটা খারাপ হয়ে আসল।সারাদিন বৃষ্টি হল।রাতেও গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ল। সকালে আকাশ ফাঁকা হয়ে এসেছে।সে যথারীতি স্কুলে যাওয়ার পথে রহিমাকে সাথে নিয়ে রওনা দিল।কাদামাখা রাস্তা পেরিয়ে যখন তারা স্কুলে পৌঁছল তখল ক্লাস শুরু হয়ে গেছে।তারা চুপিসারে ক্লাসে ঢুকে মাস্টারমশায়ের চোখকে ফাঁকি দিয়ে পেছোনের সারিতে গিয়ে বসল।মাস্টারমশায় বই খুলে সামনে রেখে দিয়ে বলতে শুরু করলেন দেশের অবস্থা নাকি ভাল নয়। সকলকে সাবধানে থাকতে বললেন।
মিলিটারিরা নাকি অত্যাচার শুরু করেছে,দেশে লুটপাট করছে।১৯৫২ সালে রফিক,শফিক,জব্বার প্রান দিয়েছে দরকার হলে আমরাও দেব,এই দেশটা আমাদের।এসব বলতে বলতে তিনি উত্তেজিত হয়ে পড়লেন।পরক্ষণেই তিনি নিজেকে সামলে নিলেন এই ভেবে যে এদের বয়স এসবের উপযুক্ত নয়।কিন্তু রানু ঠিকই বুঝল।বাবার কাছে রফিক,শফিক,জব্বার এদের গল্প কতবার শুনেছে সে। মাস্টারমশায় শুধু যেন তার বাবার বপণ করা সেই স্বাধীনতার বীজকে অংকুরিত করলেন।মাস্টার মশায়ের একটা কথা তার খুব মনে ধরেছে,এই দেশটা আমাদের।নীলুর সাথে ঝগড়া হলে সে বলে তাদের বাড়িটা নাকি নীলুদের জায়গার উপরে,নীলুর বাবা নাকি তাদের থাকতে দিয়েছে।
সে মনে মনে ঠিক করল,নীলু যদি আবার এ ক্থা বলে তাহলে সে বলে দেবে যে ওই জায়গাটা শুধু তাদের নয়,এই পুরো দেশটাই তাদের,আমাদের সবার।হয়ত তার সরল মস্তিস্ক এই জটিল বাক্যটিকে এভাবেই সরল করে নিয়েছে ।হয়ত বা তার কোমল হৃদয় এভাবেই তার অজান্তেই তার দেশটাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে।ক্লাসের নিরবতা ভেঙ্গে রাকিব প্রশ্ন করে বসল,পৃথিবীটা কি গোল মাস্টার মশায়?তিনি উত্তর দিলেন,হ্যাঁ।আর হঠাৎ ছুটির ঘন্টা পড়ে গেল।রানু বাড়ি ফিরছে আর ভাবছে পৃথিবী কিভাবে গোল হতে পারে?
পাশেই সে একটা মৃদু আর্তনাদ শুনতে পেল।চোখ পড়তেই সে দেখলো একটা বিড়াল ছানা গাড়ির চাকার নিচে পিষ্ঠ হয়ে পড়ে আছে। রাস্তায় রক্তের ছোপ ছোপ দাগ।সে তাড়াতাড়ি বাসায় এসে ভ্যাবলাইকে খুঁজতে লাগল।ঘরের এককোণে ওকে পেয়ে কোলে তুলে নিল।এর দুদিন পরই গ্রীষ্মের ছুটিতে স্কুল বন্ধ হয়ে গেল। এখন সে ভ্যাবলাইকে চোখে চোখে রাখে।
আজ ৭ জুন,১৯৭০
রানুর জন্মদিন।মা তাকে লাল টুকটুকে চুড়ি কিনে দিয়েছে। ওগুলো পরেই সে স্কুলে এসেছে।মাস্টারমশায় আজ ক্লাসে নতুন কিছু একটা দেখাবেন বলেছেন।তাই সবাই অধীর আগ্রহে বসে আছে।তিনি ক্লাসে ঢুকে সবাইকে বসতে বলে তার ব্যাগ থেকে কি জানি একটা বের করে উপরে তুলে ধরলেন।রানু দেখল একটা সবুজ কাপড় যেটার মাঝখানে কি সন্দুর লাল রং করা ঠিক যেন তার চুড়ির রং।এটা নাকি তার দেশের পতাকা,গতকালই নকশা আঁকা হয়েছে এটার।মাস্টারমশায় যখন বললেন,যে এই দেশটাকে ভালবাসে সে এই পতাকাকেও ভালবাসে,এর কোন অসম্মান হতে দেয় না।
রানু তখন কোন দেরি না করে তার সবচেয়ে প্রিয় খাতাটার এক পাতা জুড়ে পতাকার নকশা এঁকে নিল।রানু মনে মনে ভাবছিল কে এত সুন্দর পতাকা তৈরী করেছে,কেনই বা বৃত্তটার রং তার হাতের চুড়ির সাথে মিলে গেল।সে বারবার লাল বৃত্তটার সাথে তার চুড়ির রংটাকে মেলানোর চেষ্টা করছিল। পতাকাটা তার খুব পছন্দ হয়েছে।সেও একটা বানাতে চায়।
হঠাৎ কোন অজানা কারণে রানুর স্কুল বন্ধ হয়ে গেল।দূরে কোথাও খেলতে যাওয়াও তার নিষেধ।রানুর আর বন্দি থাকতে ভাল লাগেনা।মাঝে মাঝে সে জানালা দিয়ে দেখতে পায় অনেক মানুষ জয় বাংলা বলতে বলতে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে।সেও মাঝে মাঝে বুঝে না বুঝে তাদের সাথে জয় বাংলা বলে ওঠে। সারাদিন ভ্যাবলাইয়ের কোন দেখা নেই,রানু সুই সুত নিয়ে সেলাই করতে বসেছে।সেলাই করা সে নীলুর কাছে শিখেছে।আগে পুতুলের জামা সেলাই করত আজ পতাকা সেলাই করছে।কোথা থেকে যেন দুই টুকরা লাল আর সবুজ কাপড়ও জোগাড় করে নিয়েছে।
দুদিনের প্রচেষ্টায় সে যেনতেন ভাবে একটা পতাকা বানিয়ে ফেলেছে।একটি লম্বা লাঠির মাথায় সেটিকে বেঁধে বাড়ির উঠান থেকে একটু দূরে উঁচু করে রেখেছে যেন সবার চোখে পড়ে।রোজ সে পতাকাটা দেখে আসে।বাতাসের ছোঁয়ায় যখন সেটিতে ঢেউ খেলে তখন সে একদৃষ্টে চেয়ে তার সৌন্দর্য উপভোগ করে।
রানু বাইরে রহিমার মার গলার আওয়াজ পেল।দেখলো তার মাকে কিছু একটা বলে রহিমাকে নিয়ে দৌড়ে চলে গেল রহিমার মা।রানুর মাও দৌড়ে এসে একটা ময়লা ব্যাগে হালকা হাওয়া দিয়ে জামা কাপড় তাতে ভরতে লাগল।রানুকে বসে থাকতে দেখে তাকে মুড়ির কৌটটা আনতে বলল।তাদের নাকি বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে।
সে মাকে বলল কোথায় যাবে তারা।তার মা কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বলল,এ দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে মা।রানু মনে মনে ভাবতে লাগল এ বাড়িটার মত দেশটাও কি তাদের নয়।তাহলে কি মাস্টারমশায় মিথ্যে বলেছিলেন।তার মা তার হাত ধরে হেচকা টান দিয়ে দ্রত হাঁটা ধরল।হাঁটতে গিয়ে রানুর মনে পড়ল সে তার পতাকাটা ফেলে এসেছে।সে উঠানের দিকে দৌড় দিল।লাঠির মাথা থেকে পতাকাটা খুলে নিল।হঠাৎ গুলির শব্দে আকাশ কেঁপে উঠল।চারিপাশে গুলির বৃষ্টি শুরু হল।একটা গুলি এসে লাগল তার পায়ে।যন্ত্রণায় সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
রানু উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই আরেকটা গুলি তার বুক ফুঁটো করে বেরিয়ে গেল।তার শরীর থেকে ঝরে পড়া রক্তে মাটি লাল হয়ে উঠল।তার দেহটা শেষ একটা কাঁপুনি দিয়ে নিস্তেজ হয়ে গেল।তার হাতটা মাটি আকড়ে ধরার বৃথা চেষ্টা করে চিরদিনের মত থেমে গেল।যেন তার আত্তা দেহ ত্যাগ করলেও এ মাটিকে আঁকড়ে ধরে এখেনেই থেকে যেতে চায়।এ দেশ যে একান্তই তার,এ মাটিতে রয়েছে তারই অধিকার।
রায়হানুল ইসলাম শাকিল
২য় বর্ষ,ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগ,
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রকাশিত: মাসিক বর্ণালী ম্যাগাজিন
More Stories
চন্দ্রবোড়া সাপ কামড়ালে কি করা উচিত
সাপ্তাহিক চাকরির খবর ২০২৪
রাসেল ভাইপার কেন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে