বাঙালিদের কে যারা হত্যা করেছিল তাদের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্থানী আর্মি এবং তাদের দোসর রাজাকার বাহিনী ছিল অন্যতম। রাজাকারদের মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগ ছিল উর্দু ভাষা ভাষী পশ্চিম পাকিস্থানের নাগরিক যারা ভারত পাকিস্থান ভাগ হবার পরে পূর্ব পাকিস্থানে এসেছিল এবং বাঙ্গালদের সাথে তাদের সম্পর্ক খুব একটা ভাল ছিল না। যুদ্ধ শুরুর পরে যখন হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছে পাকিস্থানিরা তখন বাঙালিদের সাথে বেসামরিক অবাঙ্গালিদের মধ্যে কোথাও কোথাও দাঙ্গা হাঙ্গামার কথা শোনা গিয়েছে। উর্দু ভাষা ভাষী বেসামরিক অবাঙ্গালিরা সর্বদাই বাঙালিদের হামলার লক্ষবস্তু হয়েছিল কারণ তারা শুরু থেকেই পশ্চিম পাকিস্থানিদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে সাহায্য করতো। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে পশ্চিম পাকিস্থানি সরকার সর্বদা তাদের ব্যবহার করতো বাঙালিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করতে।
পাকিস্থানি সরকারের একটা নিজেস্ব যুক্তি ছিল বহির্বিশ্বের কাছে তাদের এই বিপুল সংখ্যক হত্যা যজ্ঞ ও কম পক্ষে ১০ মিলিয়ন মানুষ ভারতে শরণার্থী হিসাবে আশ্রয় নিয়েছে মাত্র ৬ মাসে। এ সব ই পাকিস্থান সরকারের নির্দয় সামরিক কর্মকাণ্ডের ফসল। মার্চ মাসে জেনারেল টিক্কা খান পাকিস্থানের সামরিক ক্ষমতার অধিকারী হবার পর পূর্ব পাকিস্থান থাকে সমস্ত হিন্দু নাগরিক ও বাঙালি জাতিকে হত্যার মধ্যে দিয়ে শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন কিভাবে প্রকৃত মুসলিম হওয়া যায়।
সামরিক অপারেশন এর পরিকল্পনা ছিল প্রধানতঃ
১। পূর্ব পাকিস্থান থেকে এমন ভাবে এগাছা (বাঙ্গালি) দমন করতে হবে যাতে সমস্ত অমুসলিম হিন্দু নাগরিক সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
২। প্রগতিশীল ও পূর্ব পাকিস্থানের দেশ প্রেমিক মুসলিমদের কে হত্যা।
৩। বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী বাঙালিকে যথেষ্ট পরিমাণে সংখ্যা লঘু জনসংখ্যায় পরিণত করে প্রকৃত পাকিস্থানিদের জন্য নিরাপদ আবাস তৈরি করা।
৪। পূর্ব পাকিস্থানে মিলিটারি শাসন সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা।
বর্তমান পশ্চিম বাংলায় সীমান্ত এলাকাতে অবস্থিত মানুষ সে দিন দেখেছে হাজার হাজার শরণার্থী কিভাবে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। এপ্রিল মাসের শেষের দিকে ধারনা করা হয় যে ১০ লক্ষ শরণার্থী (Refugee) ভারতে আশ্রয় নিয়েছে এবং প্রধানত হিন্দু জনসাধারণ। এবং এ সংখ্যা দিন দিন প্রচুর সংখ্যায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। মে মাসের শেষে, মোট শরণার্থী দাঁড়ায় ৩৫ লক্ষ এবং মুসলিম শরণার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। পাকিস্থান সরকার অভিযোগ করে যে ইন্ডিয়া তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাচ্ছে এবং পরিস্থিতি ঘোলাতে করছে। অন্য দিকে চায়না অভিযোগ করে যে শরণার্থী ইস্যু নিয়ে ইন্ডিয়া নিজেদের মত করে গল্প তৈরি করছে এবং সীমান্ত খোলা রেখেছে। 1971 সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইন্দিরা গান্ধী যখন বিশ্বভ্রমণের বের হন তখন তিনি ইন্ডিয়ান সরকারের অর্থনৈতিক এবং আর্থসামাজিক ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে নিয়ে সংকটে থাকার জন্য পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হবেন ইন্দিরা গান্ধী এবং বলেছেন `এই বিপুলসংখ্যক নির্যাতিত শরণার্থীদের থামানোর জন্য শুধুমাত্র বুলেট ব্যবহারই সমাধান, কিন্তু ইন্ডিয়া এটা কখনোই পছন্দ করেনা`। তৎকালীন ইন্দিরা সরকার খুব বেশি ধনী রাষ্ট্র ছিল না স্বভাবতই এই বিপুল পরিমান শরণার্থী তাদের দেশের উপরে একটি বোঝা হয়ে দাঁড়ায় যার কারণ ছিল জেনারেল টিক্কা খানের সামরিক নিষ্ঠুরতা।।
সেপ্টেম্বর 10, 1971 লন্ডনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা একটি খবর প্রকাশ করে, `কোন দেশ পৃথিবীর কোন সম্প্রদায় বাস্তবিকপক্ষে আশা করতে পারে না 90 লক্ষ শরণার্থী কোন একটি দেশে তৎক্ষণাৎ জায়গা দেওয়া যায় যা পশ্চিমবাংলার ক্যাম্পগুলো একটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এই বিপুল পরিমান শরণার্থী কোন অকল্পনীয় প্রাকৃতিক ঘটনা ছিল না এটা সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক এবং সামরিক হস্তক্ষেপের ফল`।
আন্তর্জাতিক উদ্ধার কমিটি জুন মাসের শুরুতে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটিকে (আই আর সি) পাঠায় ইন্ডিয়াতে বর্তমান অবস্থা পরিলক্ষিত করার জন্য এই মিশনের উদ্দেশ্য হলো সরাসরি প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা এবং অতি দ্রুত শরনার্থীদের (Refugee) জন্য কোন জরুরী অথবা পেশাদারিত্ব বিষয়ে সহায়তা দান করা। জুলাই মাসের 28 তারিখ সেখানে বলা হয় 60 লক্ষ বাঙালি মুসলমান হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নাগরিক পূর্ব পাকিস্তান থেকে বের হয়ে আশ্রয়হীন ভাবে পশ্চিমবাংলা আসাম ত্রিপুরা মেঘালয় রাজ্য গুলোর সীমান্তবর্তী এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে। হাজার হাজার নতুন নতুন শরণার্থী আসছে প্রতিদিন এবং ইন্ডিয়ান সরকারের জন্য এটা একটি বিরাট চাপ ।
আইআরসি মিশন আরো প্রকাশ করেন যে পলায়ন কৃত শরণার্থীদের মধ্যে একটি ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে যার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের আর্মিদের নির্যাতন দায়ী। মানুষগুলোকে ঘর থেকে বিতাড়িত করা হচ্ছে মেশিনগানের সাহায্য তাদের গুলি করে মারা হচ্ছে শহর এবং গ্রামের পুরুষ নারী শিশু দেরকে বন্দুকের বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারা হচ্ছে । নারীদের উপর্যুপরি ধর্ষণ করা হচ্ছে । মৃতের সংখ্যা জুন মাস পর্যন্ত 2 লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে। জুন মাসের 15 তারিখ পর্যন্ত ইন্ডিয়াতে শরণার্থী সংখ্যা 58 লক্ষ ছাড়িয়ে যায় এদের দুই-তৃতীয়াংশ আসামের ত্রিপুরা এবং মেঘালয় অঞ্চলে অস্থায়ী ক্যাম্প করে দেয়া হয়েছে। এক-তৃতীয়াংশ হিন্দু এবং উচ্চ পর্যায়ের মুসলমান যাদের ইন্ডিয়াতে নিকট-আত্মীয় রয়েছে তাদেরকে ক্যাম্পের বাহিরে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। আইআরসি মিশরের রিপোর্ট রেডক্রস কারিতাস অক্সফাম রামকৃষ্ণ মিশন ভারত সেবাশ্রম সংঘ এবং অন্যান্য সামাজিক কল্যাণমূলক সংগঠনগুলো প্রতিনিয়ত রিলিফ দেওয়ার কাজ করছে এবং এই সংখ্যা 60 লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে জুনের শেষ পর্যন্ত কমপক্ষে 10 লক্ষ শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে কোন গ্রামের জঙ্গল অথবা সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোর রাস্তার উপরে শীঘ্রই ভারত সরকার আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনগুলোর সহায়তায় একটি শরণার্থী ক্যাম্প করেছেন যেখানে তারা অন্তত পক্ষে একটি ছাদ এবং খাবার খেতে পারে। অনেকগুলো শরণার্থী (Refugee) ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছে স্কুল এবং কলেজ গুলোতে।
শরণার্থীর (Refugee) সংখ্যা বেড়েই চলেছে। জুন মাসের শুরুতে কলেরা রোগের প্রাদুর্ভাব হয় এবং পূর্বপাকিস্তানে এটা বিস্তার লাভ করে যার কারণে সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার ক্ষেত্রে মন্থর গতি পরিলক্ষিত হয় কিন্তু আইআরসি মিশন রিপোর্ট প্রকাশ করেন যে কলেরা ভীতি থাকা সত্ত্বেও হাজার হাজার মানুষ রাতের অন্ধকারে সীমান্ত পাড়ি দেয় পাকিস্তানি দের হাত থেকে মুক্তির আশায় যেখানে পাকিস্তানি সেনারা মর্টার হামলা করে সীমান্তবর্তী এলাকায়। এই ধ্বংসযজ্ঞের থামানোর কোন লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়নি ।
যদি বর্তমান অবস্থার মতো শরণার্থী সংখ্যা বাড়তে থাকে জুলাই মাসের মধ্যেই 70 লক্ষ ছাড়িয়ে যাবে। আইআরসি মিশন বলে 70 মিলিয়ন মানুষ একটি দেশের সমস্ত জনসংখ্যার সমান যেমনটা আফ্রিকার একটি দেশ কিউবা। শরণার্থীদের মধ্যে অনেকেই 150 মাইল পর্যন্ত পায়ে হেঁটে গ্রাম শহর পার হয়ে ভারত সীমান্তে পৌঁছে এবং পৌঁছামাত্রই তারা হিন্দু ধর্মীয় রীতি নীতি অনুসারে হিন্দু নারীরা উলুধ্বনি দিয়ে উল্লাস প্রকাশ করে এই ভেবে যে তারা এখন মৃত্যুর ভয় থেকে নিরাপদ অবস্থানে এসেছে এবং প্রার্থনা করে।
শরণার্থীদের (Refugee) মধ্যে অনেকেই 150 মাইল পর্যন্ত পায়ে হেঁটে গ্রাম শহর পার হয়ে ভারত সীমান্তে পৌঁছে এবং পৌঁছামাত্রই তারা হিন্দু ধর্মীয় রীতি নীতি অনুসারে হিন্দু নারীরা উলুধ্বনি দিয়ে উল্লাস প্রকাশ করে এই ভেবে যে তারা এখন মৃত্যুর ভয় থেকে নিরাপদ অবস্থানে এসেছে এবং প্রার্থনা করে।
এই বিপুল পরিমান শরণার্থীদের মধ্যে অনেকে রয়েছে যারা পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যভাগে অবস্থান করার কারণে শরণার্থী হয়ে ভারতে আসতে পারেনি শরণার্থীরা প্রথমদিকে সীমান্ত পার হয়েছিল শরণার্থীরা প্রথমদিকে রাস্তা দিয়ে ভারত সীমান্তে এসে পৌঁছে ছিল কিন্তু পরবর্তীতে পাক আর্মিরা ভারত সীমান্তের ১৩০০- মাইল এলাকা জুড়ে রাস্তায় অবস্থান করতে থাকে ফলে শরণার্থীরা বন জঙ্গল বিল নদী এমন সব গোপন পথে তারা সীমান্ত অতিক্রম করেন।
শরণার্থীরা (Refugee) এসেছিল বিশাল 11 টি গ্রুপে যেখানে 50000 শরণার্থী প্রতি 24 ঘণ্টায় ভারত সীমান্ত অতিক্রম করে অনিক শরণার্থীরা মুসলিম শরীর হৃদয়বান ব্যাক্তিরা সাহায্য নিয়েছিল এবং তেমন হৃদয়বান মুসলিম বন্ধুরা শরণার্থীদের সাবধানে মিলিটারিদের চোখ এড়িয়ে সীমান্ত অতিক্রম করতে সর্বোচ্চ সহায়তা করেছিল কখনো কখনো ঝড় বৃষ্টির মধ্যে বাড়িতে স্থান দিয়েছিল সমস্ত শরণার্থী রা ক্যাম্পে অবস্থান করেনি। কোন কোন পরিবার অথবা বিচ্ছিন্ন ভাবে ন্যূনতম জল এবং শক্ত মাটি পেয়ে সীমান্ত পেরিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল।
শরণার্থী (Refugee) হিসেবে ভারতে থাকা অবস্থায় অনেক শরণার্থী দিনমজুরের কাজ করেছে যাদের সরকারি রিলিপ পাওয়ার ব্যবস্থা নগণ্য ছিল অথবা অপর্যাপ্ত। সাংগঠনিকভাবে ভারত সরকার কর্তৃক স্থাপিত ক্যাম্পের আকার ছোট্ট কিছু গ্রুপ থেকে শুরু করে 50000 শরণার্থী থাকতে পারতো।
More Stories
পুন্ড্রবর্ধন: ঐতিহাসিক রহস্যের এক অধ্যায়
চন্দ্রবোড়া সাপ কামড়ালে কি করা উচিত
সাপ্তাহিক চাকরির খবর ২০২৪