মহামারী সংকলন-৩ খ্রিস্টাব্দ ১৬৫-১৮০ এর অ্যান্টোনিন প্লেগ মহামারী
যখন আমরা প্লেগ নিয়ে কথা বলি , তখন সাধারণত আমরা সেই প্লেগ নিয়ে কথা বলি যা মধ্যযুগীয় সময়ে লক্ষাধিক ইউরোপীয়ানদের মৃত্যুর কারণ হয়। তবে ইউরোপীয় ইতিহাসে ভিন্নরূপ দেওয়ার এটিই একমাত্র মহামারী ছিল না। ১৬৫ খ্রিস্টাব্দে রোমান সাম্রাজ্যে এক রহস্যজনক মহামারী ছড়িয়ে পড়ে। এই মহামারীই অ্যান্টেনাইন প্লেগ নামে পরিচিত। এই মহামারীটি সম্ভবত ১৬৬ খ্রিস্টাব্দে চীনের সিল্ক রোড ধরে পশ্চিম দিক পেরিয়ে বাণিজ্য জাহাজের মাধ্যমে রোমে ছড়িয়ে পড়ে। কখনও কখনও একে গ্যালেনের প্লেগ ও বলা হয়।
এই মহামারীর প্রাদুর্ভাব রোমান সাম্রাজ্যকে প্রায় ভেঙ্গে ফেলেছিল। এটি খ্রিস্টাব্দ ১৮০ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। এই মহামারী এমন কাজ করেছিলো যা রোহিঙ্গাদের সেনাবাহিনীও করতে পারে নি। খ্রিস্টাব্দ ১৬৫ তে রোম সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটে। রোম সাম্রাজ্য ২ জন শাসকের মাঝে বিভক্ত ছিল। দার্শনিক মার্কস অরেলিয়াস এবং যোদ্ধা লুসিয়াস ভেরিয়াসের মধ্যে ভাগ করা ছিল। ভেরিয়াস যুদ্ধ জয়ের পর বর্তমান ইরান থেকে ফিরে ছিলেন। তিনি ও তার সৈন্যদল মন্দির থেকে লুটকৃত প্রচুর ধন-সম্পদ নিয়ে ফিরেছিলেন। এবং তারা নিজেদের অজান্তেই পশ্চিম এশিয়া থেকে নিয়ে এসে ছিলেন আরও এক জিনিস। আর তা হলো বসন্তের ভাইরাস।যা পূর্ব এশিয়ায় আগের বছরই মারাত্নক প্রভাব ফেলেছে। সেনাবাহিনী রোমে পৌছাতে পৌঁছাতেই চারিদিক ছড়িয়ে পড়ে। সৈন্যরা যেই যেই জায়গা অতিক্রম করে এসেছিল সব জায়গায় ছড়িয়ে পরে এই মহামারী ।
প্রথমে এশিয়া মাইনরে, পরে গ্রীসে এরপর ইতালিতে। রহস্যজনক এই মহামারী আগ্নেয়গিরির লাভার মত চারিদিকে ছড়িয়ে পরতে শুরু করে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ইতালির ঘনবসতিপূর্ণ রোমান শহরগুলো। পুরো ভূমধ্যসাগর কেন্দ্রিক বাণিজ্য রোমান রা নিয়ন্ত্রন করতো। বাণিজ্য জাহাজ ও সেনাবাহিনীর ব্যস্ততাপূর্ণ পরিস্থিতির কারণে রোগটি আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। পরের দুইদিক এই মহামারীকে সঙ্গী করেই জীবন চালিয়ে করতে হয়েছে রোমানদের। ১৮০ এর দিকে রোগটি প্রায় শেষ হয়ে যায়। পরে ১৮৯ সালে আবার দেখা দেয় এই রোগ।
এইবার মহামারীটি দৈনিক গড়ে ২,০০০ জন মারা যেত এবং রোমান সাম্রাজ্যের প্রায় ৭-১০% মানুষ মারা গিয়েছিল। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা গুলোতে মৃত্যুর হার ছিল ১৫% বা এর বেশিও হতে পারে। এমনকি সম্রাটদেরও রেহাই দেয় নি এই মহামারী। লুসিয়াস ভেরিয়াস মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে ১৬৯ খ্রিস্টাব্দে মারা গিয়েছিলেন এবং মার্কস অরেলিয়াস ও একই রোগে ১৮০ খ্রিস্টাব্দে মারা যান। তখনকার খ্যাতিমান চিকিৎসক গ্যালেন ছিলেন মার্কস অরেলিয়াসের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ।
প্লেগ রোগের উৎপত্তি কোথায়: মহামারী সংকলন-1
মহামারী সংকলন-২ খৃষ্টপূর্ব ৪৩০ এর এথেন্সের প্লেগ মহামারী
মহামারী সংকলন-৩ খ্রিস্টাব্দ ১৬৫-১৮০ এর অ্যান্টোনিন প্লেগ মহামারী
মহামারী সংকলন-৪ ( খ্রিস্টাব্দ ২৫০-২৭১ সাইপ্রিয়ান প্লেগ মহামারী )
মহামারী সংকলন- ৫ (খ্রিস্টাব্দ ৫৪১-৫৪৯ জাস্টিনিয়ার প্লেগ মহামারী)
মহামারী সংকলন-১ চীনের প্রাগৈতিহাসিক মহামারী
তিনি জ্বর, ডায়রিয়া এবং ফ্যারঞ্জাইটিস এর পাশাপাশি উত্তপ্ত ত্বক , কখনও কখনও স্ফীট যা অসুস্থতার নবম দিনে প্রকাশিত হয় ; এইগুলোকে রোগের লক্ষণ বর্ণনা করেছিলেন।অনেকেই মহামারীর আতঙ্কে যাদু টোনার দ্বারস্থ হতে শুরু করেন। একটি বিশেষ মন্ত্র মহামারী চলা কালে পুরো জাতির কাছে পাঠানো হয়েছিল এবং রাজ্যের সকল প্রবেশ পথে লেখা হয়েছিল। বিশেষত যে সকল ঘর খালি ছিল। মার্কস অরেলিয়াস তার দার্শনিক মেডিটেশন রচনায় উল্লেখ করেন, তার চারপাশে মহামারীর থেকেও যা মারাত্মক ছিল তা হল মিথ্যা, দুষ্ট আচরণ এবং কারোর সত্য আচরণ বোঝার অভাব।
তিনি যখন মারা যাচ্ছিলেন তখন তিনি বলে যান , “আমার জন্য কাঁদবেন না; মহামারীর কথা ভাবুন এবং আরও অনেকের মৃত্যুর কথা চিন্তা করুন।“অসুস্থতার প্রভাব সামরিক ও অর্থনৈতিক দোটানায় সীমাবদ্ধ ছিল না। মার্কস অরেলিয়াস খ্রিস্টানদের উপর নিপীড়ন শুরু করেছিলেন যারা দেবতাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে অস্বীকার করেছিল। সম্রাট মনে করেছিলেন এজন্যই হয়তো দেবতারা রুষ্ট হয়ে তাদের ধ্বংস করতে মহামারী দিয়েছেন।
মহামারী শুধু মানুষের জীবন নিয়ে যায় নি। পরিবর্তন এনেছিল মানুষের মূল্যবোধের। স্পষ্টতই অপ্রীতিকর ছিল বসন্ত রোগটি পুরো রোমান সম্রাজ্যের উপর প্রভাব ফেলেছিল। তারা হারিয়েছিল জনপদ, হারিয়েছিল সৈন্য, পঙ্গু হয়েছিল বাণিজ্য ও অর্থনীতি। যার ফলে মানুষের মধ্যে ঘটেছিল মূল্যবোধের অবক্ষয় ।