জাস্টিনিয়ানের শাসনামলে (৫২৭-৫৬৫ খ্রিষ্টাব্দ) এক ভয়াবহ প্লেগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল যা কিনা লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছিল। এই মহামারী ২২৫ বছর যাবৎ পৃথিবীতে এর আধিপত্য দেখিয়ে ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে শেষ হয়। এই মহামারী ৫৪২ খ্রিষ্টাব্দে কনস্টান্টিনোপলে প্রথম দেখা যায়। তার ঠিক এক বছর পর উক্ত রাজ্যের বাইরে এর প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ে যার শুরু ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে, তারপর পুরো বিশ্বে। এই মহামারী চীন ও উত্তর পূর্ব ভারতে উদ্ভূত হয়। প্লেগটি (ইয়ারসিনিয়া পেস্টিস) আফ্রিকার গ্রেট লেক অঞ্চলে যায় উপকূলীয় সমুদ্র বাণিজ্যের মাধ্যমে। জাস্টিনের প্লেগের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল মিশর। সিজারিয়ার বাইজেনটাইন ঐতিহাসিক প্রোকোপিয়াসের মতে, প্লেগের শনাক্তকরণের সূচনা হয়েছিলো নীল নদের উত্তর ও পূর্ব উপকূলে। প্লেগ লেখক ওয়ন্ডি অরেন্টের মতে, এই রোগ-টি দুই দিক থেকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে (উত্তর দিক থেকে আলেকজান্দ্রিয়া এবং পূর্ব দিকে ফিলিস্তিন পর্যন্ত)। এই মহামারী-টি ছড়ানোর প্রধান কারণ ছিল কালো ইঁদুর, যেগুলো কিনা শস্য জাহাজ এবং গাড়িতে করে চলে এসেছিলো। অষ্টম খ্রিষ্টীয় শতাব্দীতে উত্তর আফ্রিকা ছিল সম্পদের প্রাথমিক উৎস। শস্যের এবং কাগজ, তেল, হাতির দাঁত এবং দাস সহ বিভিন্ন পণ্যদ্রব্যের। বৃহৎ গুদাম গুলিতে সজ্জিত শস্য ও খড় ছিল ইঁদুরের জন্য একটি উপযুক্ত প্রজনন কেন্দ্র। যা কিনা রোগটি ছড়াতে সাহায্য করেছিলো। জাস্টিয়ান ফ্লাইয়ার উইলিয়াম রোজেনের মতে, ইঁদুর সব কিছু খেয়ে থাকলেও ইঁদুরগুলির প্রিয় খাবার শস্য । তিনি আরও লক্ষ্য করেছেন যে, ইঁদুরগুলো সাধারণত তাদের জন্মস্থান থেকে ২০০ মিটারের বেশি ভ্রমণ করে না। তাই বলা চলে ইঁদুরগুলো একবার নৌকায় চড়ে, একবার কার্টে চড়ে সারা সাম্রাজ্য ছড়িয়ে পড়েছিলো। ঐতিহাসিক কলিন ব্যারাসের মতে, প্রোকোপিয়াস উক্ত সময়কালের দক্ষিণ ইতালিতে জলবায়ু পরিবর্তনগুলি রেকর্ড করেছিলেন। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন, গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময়ে তুষারপাত ও অস্বাভাবিক তাপমাত্রা হ্রাসের ঘটনা ঘটে এবং গড় তাপমাত্রা অনেক কমে যায় সাথে রোদ হ্রাস পেতে থাকে। তাই শুরু হয়েছিলো এক দশক দীর্ঘ ‘Cold Snap’ এবং তার সাথে যুক্ত হয়েছিলো সামাজিক বাঁধা, যুদ্ধ এবং প্লেগের প্রথম রেকর্ড প্রাদুর্ভাব। স্বাভাবিকের থেকে শীতল আবহাওয়া ফসলের ফলনকে প্রভাবিত করেছিল, এবং এর ফলে খাদ্য সংকটের দেখা দেয় উক্ত অঞ্চলে। এই এলাকার রোহিঙ্গাদের সংক্রমিত ইঁদুর কামড় দেয় এবং তাদের সংক্রমিত করে। শীতের কারনে ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত মানুষগুলো যুদ্ধের সময় রোগ, অসুস্থতা এবং সংক্রামক বহনকারী ইঁদুরের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে এবং তা চারদিক ছড়িয়ে যেতে শুরু করে। পুরো পরিস্থিতি মহামারীর অনুকূলে ছিল।
বাইজেন্টাইন সম্রাট জাস্টিন প্রথমের নাম অনুসারে প্লেগের নামকরণ করা হয় জাস্টিনিয়ার প্লেগ। এই মহামারীতে ইউরোপের প্রায় অর্ধেক জনগণ প্রভাবিত হয়েছিল। কবর থেকে পাওয়া হাড়ের ডিএনএ বিশ্লেষণের ভিত্তিতে পাওয়া তথ্য থেকে বিশেষজ্ঞরা বলেন, জাস্টিনিয়ার রাজত্বকাল বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের যে ধরণের প্লেগ আক্রমণ করেছিল তা ছিল বুবোনিক (ইয়ারসিনিয়া পেস্টিস) যদিও এটি খুব সম্ভবত প্রবল সম্ভাবনাময় ছিল। এটি ছাড়াও দুইটি প্লেগ হওয়ার সম্ভাবনাও ছিল। এছাড়া নিউমোনিয়া এবং সেপটিসেমিকও বর্তমান ছিল। বুবোনিক প্লেগ চতুর্থ শতাব্দীর ইউরোপ-কে ধ্বংস করেছিলো। এই মহামারী পৃথিবীর প্রায় অর্ধকোটির মানুষ বা তখনকার সময়ের পৃথিবীর অর্ধেক মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছিলো। ইতিহাসে এটি ব্লাক ডেথ হিসেবে বেশি পরিচিত। জাস্টিনিয়ার সময়েও প্লেগ ইতিহাসের কোনো নতুন রোগ ছিল না। ওয়েন্ডি ওয়েট পরামর্শ দেয় যে বুবোনিক প্লেগের প্রথম রেকর্ডকৃত বিবরণ পুরাতন টেস্টামেন্টে ফিলিস্তিনীদের গল্প বলা হয়েছিল যেখানে যে Ark of the Covenant চুরি করে ছিল সে “ফুলে” মারা যায়। প্রোকোপিয়াস তার গুপ্ত ইতিহাসে ভুক্ত ভোগীদের বর্ণনা করেছেন যে, তারা বিভ্রান্তি, দুঃস্বপ্ন, জ্বর এবং কুঁচকে যাওয়া, বগলে এবং কানের পিছনে ফোলা ভাবে ভুগছেন। প্রোকোপিয়াসের বর্ণনা মতে, কিছু ভুক্তভোগী কোমায় পড়ে যান, অনেকে অতিরিক্ত বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। অনেকে মৃত্যুর আগে কয়েকদিন ভুগে তারপর মারা যান, আবার অনেকে লক্ষণ দেখার সাথে সাথেই মারা জান। প্রকোপিয়াসের বর্ণনা অনুযায়ী, এ জাতীয় লক্ষণের কারণ হিসেবে বুবোনিক প্লেগ কে দায়ী করা হয়। তিনি এর প্রাদুর্ভাবের জন্য সম্রাটদের দোষারোপ করেছিলেন। এবং জাস্টিন কে শয়তান বলে ঘোষণা করেছিলেন। বলেছিলেন জাস্টিনিয়ানের পাপ কাজের শাস্তি সৃষ্টিকর্তা দিচ্ছেন সবাইকে। যুদ্ধ ও বাণিজ্যের জের ধরে পুরো বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে প্লেগের বিস্তার ঘটে। জাস্টিনিয়ান তার রাজত্বের শুরুর বছর গুলি বিভিন্ন শত্রুদের পরাজিত করে পার করেছেন। ইতালি নিয়ন্ত্রণে আনতে অস্টোগোথের সাথে যুদ্ধ করেন; উত্তর আফ্রিকা নিয়ন্ত্রণে আনতে ভ্যান্ডাল এবং বারবার্সের সাথে যুদ্ধ করেন এবং সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িত ফ্রাঙ্কস, স্লাভস, আভারস এবং অন্যান্য বর্বর উপজাতির হাত থেকে রাজ্য কে রক্ষা করেন।
ঐতিহাসিকরা পরামর্শ দিয়েছেন যে, সৈন্যদের নেবার জন্যে পাঠানো ট্রেন এবং তাদের সামরিক প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেন। ওয়েন্ডি ওরেন্চ এই রোগের বর্ণনা করে বলেন, সাম্রাজ্যের বাণিজ্য পথে আসা ইঁদুর গুলোর আক্রান্ত মাড়ি এই প্রথম বাহক হিসেব ধরা হয়। এটি কনস্টান্টিনোপলে ৪ মাস প্রাদুর্ভাব চালিয়েছিলো, তবে প্রায় তিন শতাব্দী ধরে স্থায়ী ছিল। এই প্লেগের আক্রমণ এতটাই ভয়াবহ ছিল যে সম্রাট নিজেও আক্রান্ত হন, যদিও তিনি মারা যান নি। রাজধানীর বাস্তায় মৃতদের লাশ স্তূপ আকারে পড়ে ছিল। জাস্টিনিয়ান সৈন্যদের মৃতদের সৎকার করতে সহায়তা করার আদেশ দিয়েছিলেন। এক বারে কবর খুঁড়ে তাতে লাশ গুলো দিয়ে তাদের মাটিচাপা দেওয়া হয়। জায়গা শেষ হয়ে গেলে লাশ গুলো সাগরে ফেলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। শুধুমাত্র আক্রান্ত মানুষই নয় বিড়াল কুকুরসহ সকল প্রাণীর মরদেহ নিশ্চিহ্ন করার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। যখন মানুষের জন্যে কোনো চিকিৎসা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না তখন তারা ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল, আশীর্বাদী পাউডার , জাদু তাবিজ , আংটি ইত্যাটিতে বিশ্বাস করতে শুরু করে। পরবর্তীতে তারা মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও হাসপাতালের চিকিৎসার উপরে ভরসা করতো। প্লেগের কারণে রাজনীতি ও অর্থনীতি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৫৬৮ খ্রিস্টাব্দে লম্বার্ডস উত্তর ইতালি আক্রমণ করে সফল হয়েছিলো এবং ছোট বাইজেন্টাইন হ্যারিসনকে পরাজিত করেছিলো , যার ফলে ইতালীয়ান উপ-দ্বীপে ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয় । প্রকোপিয়াস বলেছেন, কনস্ট্যান্টিনোপলে দৈনিক ১০,০০০ মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া যেত। তবে আধুনিক ঐতিহাসিকদের মতে , রাজধানীতে দৈনিক ৫,০০০ মৃত্যু অনুমান করা হতো, এর সত্ত্বেও কনস্টান্টিনোপলের ২০-৪০% বাসিন্দা অবশেষে মারা যায় এবং পুরো সাম্রাজ্যের প্রায় ২৫% মানুষ মারা যায়। যে কোনো মহামারী-ই অর্থনৈতিক , সামাজিক ,ধর্মীয় ও খাদ্যের উপর প্রভাব ফেলে এবং যার কারনে এর বিস্তার প্রকট হয়। তাই মাথা ঠান্ডা করে ভেবে চিন্তে বুদ্ধিমানের মত পদক্ষেপ নিলেই এসকল মহামারীতে মৃত্যুর ও ক্ষয়ক্ষতির হার হ্রাস করা সম্ভব।
More Stories
Research Fund Deadline 30 June 2022 Ministry of Science and Technology of Bangladesh Govt.
Drawing of Padma Bridge and Celebration of Opening Ceremony 25 June 2022 II Riyana
Rare Photo of Padma Bridge