Colorgeo.com

Disaster and Earth Science

মূল্যবোধ কি? আমাদের মূল্যবোধের অবক্ষয়

Spread the love

মূল্যবোধ কাকে বলে?

সামাজিক ও ব্যক্তিগত মূল্যবোধ কি?

‘মূল্যবোধ’ শব্দটি ‘মূল্য’ এবং ‘বোধ’ সাধারণভাবে বুঝি কোনও কিছুর সঙ্গে মুদ্রার বিনিময় হার। কিন্তু আমরা যদি বলি—‘গ্রামীণ ব্যাংক’ বিদেশ থেকে সম্মান আনার আগে আমরা ড. মুহাম্মদ ইউনুস এর প্রতিভার সঠিক মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছিলাম”, এই বাক্যটির ক্ষেত্রে ‘মূল্য’ শব্দটি ‘মুদ্রার বিনিময় হার’ হিসেবে প্রয়োগ করা হয়নি। এখানে ‘মূল্যায়ন’ শব্দটি ‘যোগ্যতা নিরূপণ’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে ।

‘বোধ’ শব্দের অর্থ ‘জ্ঞান’, ‘বুদ্ধি’, ‘চৈতন্য’, ‘বোঝা’  অর্থাৎ কোনও ঘটনা মস্তিষ্ক-স্নায়ুকোষে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে—তাই হল সে সম্পর্কে আমাদের বোধ। ‘মূল্যবোধ’ শব্দটির একটা গ্রহণযোগ্য অর্থ আমরা পেলাম—‘যোগ্যতা বোঝা’ বা ‘যোগ্যতা নিরূপণ’-এর ক্ষমতা এবং প্রবণতা । Value-র বাংলা অর্থ ‘যোগ্যতা’।

‘Sense of value’-র বাংলা হিসেবেই আমরা ‘মূল্যবোধ’  শব্দটি ব্যবহার করি, ‘Price’-এর বাংলা অর্থ হিসেবে নয়। এই ‘মূল্যবোধ’ শব্দটির সাহায্যে আমরা কোনও কিছুর ভাল-মন্দ, উচিত-অনুচিত ইত্যাদির যোগ্যতা পরিমাপ করি ।

মূল্যবোধ

এই ‘বোধ’ বা ‘যোগ্যতা’  বোঝার ক্ষমতা সবার সমান নয়। তথাকথিত অলৌকিক রহস্য ভেদের ক্ষেত্রে আমার যা বোধশক্তি তা একটি জানোয়ার চেয়ে যতগুণ বেশি, তার চেয়েও বোধহয় বেশিগুণ বেশি আমার ফুটবল বোধশক্তির তুলনায় পেলে বা মারাডোনার ফুটবল বোধশক্তি।

মূল্যবোধ কি আপেক্ষিক?

হ্যাঁ। ‘মূল্যবোধ’ আপেক্ষিক। মূল্যের যে পরিমাপ আপনি করছেন, অর্থাৎ ‘যোগ্যতা নিরূপণ’  করছেন, তা অন্যের কাছে খারাপ মনে হতে পারে, আবার ভালও মনে হতে পারে। আপনার কাছে যা আদর্শ, অন্যের কাছে তা অনাদর্শও হতে পারে। সময় ও সমাজ অনুসারে মূল্যবোধ পাল্টায়। আবার একই দেশের মানুষদের অগ্রসর অংশেরা যে মূল্যবোধে বিশ্বাস করে, সেই মূল্যবোধ পিছিয়ে থাকা মানুষদের চোখে অবক্ষয় মনে হতেই পারে।

এক সময় সমাজের এক বৃহৎ অংশ মনে করত, স্বামীর সঙ্গে সহমরণে যাওয়াটাই নারী জীবনের চরম মূল্যবোধ । এক সময় নারী-শিক্ষা, বিধবা-বিবাহ ইত্যাদি অনগ্রসর ও রক্ষণশীলদের চোখে সমাজের অবক্ষয় বলেই ঘোষিত হয়েছে। রামমোহন রায় সতীদাহ-প্রথা রোধে আন্দোলন করেছিলেন, বিদ্যাসাগর নারী-শিক্ষা ও বিধবা বিবাহের পক্ষে আন্দোলন করেছিলেন।

রামমোহন রায় ও বিদ্যাসাগরের এই আন্দোলন অনেকের চোখেই খারাপ ঠেকেছে। তাদের মনে হয়েছে, এই আন্দোলন সমাজের অবক্ষয় ঘটাবে। আবার রামমোহন, বিদ্যাসাগরের চিন্তায় প্রভাবিত মানুষদের চোখে এই আন্দোলন মোটেই অবক্ষয় ছিল না, ছিল শ্রেয় মূল্যবোধ, যা সমাজ  পোষণ করছে না। ‘মূল্যবোধ’ আপেক্ষিক বলেই বিধবা বিবাহ, নারী শিক্ষা কারও চোখে ভাল, কারও চোখে খারাপ বলে মনে হয়েছে ৷

 

‘মূল্যবোধ’ বিষয়টিকে এবার আমরা মনস্তত্ব ও সমাজতত্ত্বের দিক থেকে ভাববার চেষ্টা করি আসুন। মনস্তত্ব ব্যক্তি ভাবনাকে ব্যাখ্যা করে, সমাজতত্ব ব্যাখ্যা করে যৌথ ভাবনাকে, গোষ্ঠীবদ্ধ ভাবনাকে । আপাতভাবে মনে হতে পারে, ব্যক্তির সমষ্টিকে নিয়েই যখন সমাজ, তখন অনেক ব্যক্তি-ভাবনার ব্যাখ্যা থেকেই তো সমষ্টির ভাবনার হদিশ মেলা উচিত অথবা গোষ্ঠীর ভাবনা ধরে আমরা পৌঁছতে পারি ব্যক্তি ভাবনায়।

আসলে বাস্তব ক্ষেত্রে ব্যাপারটা এতোটা সরলীকৃত নয় যে, সবসময় ব্যক্তি ভাবনা থেকে গোষ্ঠী ভাবনায় অথবা গোষ্ঠী ভাবনা থেকে ব্যক্তি ভাবনায় পৌঁছে যাওয়া যায়।

 

একটা উদাহরণ দিয়ে ব্যপারটা বোঝানো যাবে।

 

ট্রেনের একটি পুরুষ কামরায় যদি সমীক্ষা চালান হয়, তবে দেখতে পাবেন, এঁদের প্রায় প্রত্যেকের মধ্যেই রয়েছে সুকুমারবৃত্তি, সুন্দরের প্রতি ভালোবাসা, নাচ, গান, সাহিত্য, নাটক, সিনেমার প্রতি টান। এঁরাও ব্যক্তিজীবনে কারও না কারও বাবা, ভাই,  কারও প্রেমময়ী প্রেমিক, কারও স্বামী,  কারও বা পুত্র।

 

ব্যক্তি ভাবনার এমন পুরুষদের সমষ্টিগত অন্য এক চেহারার পরিচয় পাওয়া যাবে মাঝে-মধ্যে। কখনও কখনও খবরের কাগজের খবর হয়—বাসে হঠাৎ উঠে পড়া কোনও যুবতী মেয়েকে পুরুষ বখাটে গোষ্ঠীর তীব্র অপমান ও শারীরিক লাঞ্ছনা থেকে বাঁচতে লাফিয়ে পড়ে নাম পরিচয় হীন একজন নারীর মৃত্যু।

 

 

বাসে একটি নারীকে একা পেতেই সম্মিলিত পুরুষদের যে নিষ্ঠুরতা প্রকট হয়েছে, তার হদিশ পেতে ব্যক্তি ভাবনা ছেড়ে যৌথ ভাবনাকে ব্যাখ্যা করতে হবে। ইট দিয়ে বাড়ি তৈরি হলেও বাড়ি যেমন শুধুমাত্র ইটের পর ইট সাজানোর ব্যাপার নয়, তেমনই ব্যক্তি নিয়ে সমাজ হলেও, সমাজ শুধু ব্যক্তির সমষ্টি নয়, বাড়তি কিছু। তাই শুধুমাত্র মনস্তত্বের সাহায্যে সমাজ জীবনের ভাবনা বা সমাজ জীবনের ধারাকে ধরা নাও যেতে পারে।

 

 

মূল্যবোধ এর মনস্তত্বের দিক কি?

 

অনেক সময় এমন হয়েছে, ব্যক্তিগত মূল্যবোধ শেষ অবধি সামাজিক মূল্যবোধে রূপান্তরিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি তার চিন্তা ভাবনার দ্বারা বহুকে প্রভাবিত করেছে, বহু থেকে বহুতরতে ছড়িয়ে পড়েছে সেই চিন্তার রেশ । এই ভাবনা এক থেকে বহুতে ছড়িয়ে পড়ার মধ্যে, গোষ্ঠীবদ্ধ ভাবনাতে রূপ পাওয়ার মধ্যে যে প্রক্রিয়া, পদ্ধতি বা তত্ত্ব রয়েছে—সেও সমাজতত্ত্ব।

 

 

‘মূল্যবোধ’ বিষয়টি মনস্তত্বের দিক থেকে একটু ভাববার চেষ্টা করা যাক । ব্যক্তি মানুষের মূল্যবোধ বা নীতিবোধের প্রকাশ ও বিকাশ তার সামাজিক পরিবেশের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। পরিবেশগতভাবে কিছু মানুষের মনে হতেই পারে—,  হিন্দু বিবাহিত মেয়েদের স্বামীর জন্য কপালে সিন্দূর না পরা মূল্যবোধ অবক্ষয়েরই পরিচয়।

 

একই সামাজিক পরিবেশের প্রভাবে বেড়ে ওঠার দরুণ সাধারণভাবে ও সামগ্রিকভাবে সেই পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হলেও সেই প্রভাবেরও নানা তারতম্য ঘটে, রকমফের ঘটে। এমন কি ভিন্নতর, নতুন চিন্তা-ভাবনার উন্মেষও দেখা যায়। অনেক সময়ই দেখা যায় সমাজতত্ত্ব ও মনস্তত্ব উভয় উভয়ের সঙ্গে একটা বিরোধের ভাব পোষণ করে থাকে, সমাজতত্ত্ব যেন একটা ধারণা সবার উপর থেকে চাপিয়ে দিচ্ছে।

 

এভাবে কোন ব্যক্তির উপর বহুর চিন্তা বা সমাজের শাসকশ্রেণীর চিন্তা চাপানোর মধ্যে অনেক সময় দেখা দেয় বিরোধ।

 

শাসকশ্রেণীর চাপিয়ে দেওয়া নীতির ব্যক্তিগতভাবে প্রতিবাদ করার অধিকার আপনার, আমার সবার সব সময়ই থাকে। এই প্রতিবাদকেই আপনি, আমি সক্রিয় চেষ্টার ফলে যৌথ চেহারা দিতে পারি। কাজেই সমাজের সঙ্গে ব্যক্তিগত মূল্যবোধের সম্পর্ক একটা সচল ও যুগোপযোগী সম্পর্ক। এমন হতেই পারে আপনার, আমার ব্যক্তিগত মূল্যবোধ শেষ পর্যন্ত জনসমর্থন পেয়ে সামাজিক মূল্যবোধ হয়ে উঠতে পারে। সমাজের সঙ্গে ব্যক্তিগত মূল্যবোধের সম্পর্ক একই সঙ্গে বিরোধ এবং সংহতির।

 

তাই আমাদের বর্তমান সমাজে যে সব মূল্যবোধ রয়েছে সেগুলো আর একবার ভেবে দেখুন সেগুলো ব্যক্তিগত ভাবে মূল্যায়ন পায় কিনা? যেমন ভিন্ন মতাদর্শকে অবজ্ঞা করা, দিকভ্রস্ট মনে করা, নারীদেরকে পুরুষের তুলনায় খাট করে দেখা, এমনি আরও কত কিছু রয়েছে আমাদের বর্তমান সমাজে। আমার মনে হয় এখন সময় এসেছে আর একবার ভেবে দেখার।


অন্যদিকে বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তা  সমাজ সচেতনতা, বিশ্বাস অথবা নৃতত্ত্ব, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান ও বিজ্ঞান পড়ার ফলে, কিংবা সঞ্চিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমরা যদি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছোই—

দেশপ্রেম মানে দেশের মাটির প্রতি প্রেম নয়, দেশের সংখ্যাগুরু মানুষের প্রতি প্রেম।

সমাজসেবার মাধ্যমে শোষণ মুক্তি ঘটেছে, এমন দৃষ্টান্ত আজ পর্যন্ত কোনও ঐতিহাসিকের জ্ঞান ভাণ্ডারে নেই।

শোষক ও শাসকশ্রেণী শোষণকে কায়েম রাখতেই শোষিতদের মধ্যে এই ভ্রান্ত চিন্তাগুলোর প্রসারকামী।

পূর্বতন রাজনৈতিক নেতাদের কাছে, সংখ্যাগুরু মানুষদের কাছে, পশ্চাৎবর্তী মানুষদের কাছে, মগজ ধোলাইয়ের শিকার মানুষদের কাছে এই নতুন ধারার চিন্তার ফসল হিসেবে গড়ে ওঠা মূল্যবোধকে ‘মূল্যবোধের অবক্ষয়’  বলে মনে হতে পারে? এক্ষেত্রে যুক্তিবাদী, প্রগতিবাদী, সুস্থচেতনার মুক্তিকামী মানুষদের কাছে এই যুগোচিত পরিবর্তিত চিন্তার অর্থ অবৈজ্ঞানিক মূল্যবোধের ক্ষয় ও বিলুপ্তি সাধন বা পরিমার্জিত করা। মূল্যবোধের পরিবর্তন মানেই ‘অবক্ষয়’ অবশ্যই নয়।