আবার যাবো শৈশবে
বিজয় পাল
————-
জীবন যেন পদ্মপাতার একবিন্দু শিশির। জীবনের এই চিরন্তন সত্যকে উপেক্ষা করিয়া ঐ নীল সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের মতোই তীব্রবেগে এগিয়ে চলে এ জীবন। স্বপ্নগুলো যেন আকাশের ঐ রংধনুর মতোই।
শ্রাবনের কোনো এক সায়হ্নে যখন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল, হৃদয় ছেয়ে গিয়েছিল একাকিত্বের কালো মেঘে তখন একলা বসিয়া জীবনের প্রতিটা অধ্যায় স্মরণ করিতে করিতেই অন্তরচক্ষু একটু পিছনে ফিরে তাকাল। চোখের পাতায় ভেসে উঠল সেই স্মৃতিময় শৈশব।
সেখানে ছিল বৃষ্টিতে ভেজার আনন্দ, ছিল কাদার ভিতর গড়াগড়ি খাওয়ার আনন্দ। বৃষ্টি পড়তেই যেন বাতাবিলেবু দিয়ে ফুটবল খেলার ধুম লেগে যেত। ফুটবল খেলা শেষে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে দিয়ে পড়া, সে তো এক স্বর্গীয় অনুভুতি। বর্ষার নদীতে চালুনি দিয়ে মাছ ধরার আনন্দও বা কম কিসে? আর শৈলেন দাদুর বাতাবিলেবু গাছের বাতাবিলেবু চুরি করতে গিয়ে ধরা খাওয়ার পরে মায়ের বিনামূল্যে বকুনির সেই পরম তৃপ্তি, শৈশব ছাড়া কোথায় পাওয়া যায়? অবশ্য কানমলা খেয়ে কান দুদিন লাল থেকেই যেত।
কোনো এক বৃষ্টির দিনে স্কুলফেরার পথে কচুর পাতা দিয়ে ছাতা বানানোর বুদ্ধিটা একমাত্র শৈশবেই আসে। কলাপাতাও ছিল তখন উৎকৃষ্ট মানের ছাতা। লম্বা কলাপাতার নিচে দুই বন্ধু সামনে পিছনে টানাটানি করতে করতেই পিচ্ছিল রাস্তায় কাউকে না কাউকে পড়ে যেতেই হতো। সময়টা যেন বাড়ি, খেলার মাঠ আর স্কুলেই সীমাবদ্ধ ছিলনা। নৌকা নিয়ে বিলের মাঝখানে হারিয়ে যাওয়াটাও একটা দারুন সময়। তখন নৌকায় করে বিলের একদিক থেকে অন্যদিকে যাওয়ায় যে কি সুখ, কি আনন্দ ছিল তা হয়ত ওই শাপলা ফুল গুলোও বুঝতে পারত।
এই আনন্দই ছিল বুঝি তাদের প্রস্ফুটিত হওয়ার কারন। খুশিতে যেন ওরা হাওয়ায় গা ভাসিয়ে দুলতে থাকে। ওদের সাথে নিয়েই কর্দমাক্ত পথে হেঁটে বাড়ি ফিরে আসা হতো। পথের ঐ কাদাও যেন বন্ধুত্ব করতে চায়। তাইতো ওরাও কাছে টেনে নেয় আমাদের। ওদের ডাকে সাড়া দিয়েই হয়ত পড়ে যেতাম কাদার ভিতর।
তখন যে বর্ষা শেষে শরৎ আসার সময় হয়ে গেছে তা বুঝিয়ে দেয় বাড়ির পাশের শিউলি গাছটা। গাছে তখন কুড়ি আসতে শুরু করে। কিছু দিন পরে সকালবেলা যখন দেখা যায় যে শিউলি তলা ফুলে বিছিয়ে আছে, মনে হয় শিউলি গাছটা যেন ভাত রান্না করে মাটিতে ছড়িয়ে রেখেছে। শিশির ভেজা ঐ শিউলি ফুল কুড়ানোই ছিল তখন প্রতিদিন সকালের কাজ। কোনো কোনো দিন ফুল কুড়িয়ে মা কে বলতাম, এই দেখ কত ভাত। আজ আর তোমার রান্না করা লাগবে না। তখন দেখা যায় মায়ের ঠোঁটের কোনে একরাশ হাসি। এভাবেই হঠাৎ করে শরৎ চলে যায়।
হেমন্ত আসতে না আসতেই মনে পড়ে যে এবার তো চড়ুইভাতি করা হলো না। ভাইবোন আর বন্ধুদের নিয়ে শুরু হয়ে যায় চড়ুইভাতির আয়োজন। যার যার বাড়ি থেকে চাল, ডাল, তরিতরকারি নিয়ে কোনো এক খোলা জায়গায় যে খিচুড়ি রান্না করা হয় তার স্বাদ যেন আজীবনই মুখে লেগে থাকার মতো। এক কথায় চড়ুইভাতি মানে আনন্দ, হৈচৈ আর অনেক অনেক মজা।
কিছুদিন পর থেকেই শীতের আমেজ চলে আসে। চারিদিকে শুরু হয় খেজুর গাছ কাটা। খেজুরের পাতা দিয়ে মা পাটি বুনতো। সেই পাটির উপরই রাতে হারিকেন জ্বালিয়ে বই পড়া ছিল দৈনন্দিন কাজ।
কনকনে শীতের ভিতরেও মাথার ভিতরের দুষ্টবুদ্ধি গুলো বেশ রয়েই যায়।
গাছি যখন খেজুরের রস পাড়তে গিয়ে দেখতো যে রস নেই, তখন আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে হাসতাম আর আমাদের উদরের দিকে তাকাতাম। কারন রস তো এই উদরেই আছে এখন। চুরি করা খেজুরের রস যেন একটু বেশিই মিষ্টি লাগত। কারন রসের সাথে মিশে থাকত আনন্দ। যে সে আনন্দ নয় একেবারে চুরি করার আনন্দ।
আর শীতের সকাল মানে ছিল তো খড়, নাড়া দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে রাস্তার ধারে আগুন পোয়ানোর মজা। তারপরে পিঠেপুলি তো মাঝে মাঝেই বানানো হতো বাড়িতে। পিঠাগুলো মনে হয় চুলার উপর থেকেই আমাকে ডাকত। তাইতো আগুন পোয়ানোর বাহানায় চুলার পাশে বসেই পিঠা খাওয়া, এতো অতিসাধারণ ঘটনা। তখন কনকনে শীতে আমরা শীতের পোশাক পড়লেও গাছগাছালি গুলো পাতা ঝরিয়ে কেমন যেন আলগা থাকে। বড়ই অবাক লাগত। ওদের কি শীত নেই?
স্কুলের বড় বড় দুইটা কৃষ্ণচূড়া গাছের ঐ বড় বড় লাল ফুল গুলো বুঝিয়ে দিত এবার তবে বসন্ত এসেছে। আমরা যখন কৃষ্ণচূড়া ফুল কুড়াতাম তখন কৃষ্ণচূড়ার ঐ মগডালে বসে কোকিল পাখিটা কুহু কুহু করত। ওর মনেও হয়ত বসন্ত এসেছে। স্কুলে গিয়ে কৃষ্ণচূড়া ফুল কুড়িয়ে ব্যাগ ভর্তি করাটাও ছিল অন্য একটা কাজ।
কিন্তু মনে হতো প্রকৃতি যেন আবার ক্ষেপে উঠেছে। গ্রীষ্ম এসেই তার রুদ্রানী রূপ ধারন করেছে। মুখে তার আগ্নেয়গিরি, চোখে ভয়ঙ্কর ঝলকানি আর হাতে যেন অগ্নি তরবারি। চারিদিক যেন ঝলসে যায়। তবুও আমাদের পরাস্থ করা অত সহজ নয়। আমরা বাড়ির পাশের আমবাগানের ছায়ায় দিব্যি পাটি পেতে বসে থাকতাম আর ছোট্ট আমের গুটি কুড়াতাম।
সন্ধ্যার কালবৈশাখী ঝড়ের পরে আম কুড়ানোর সুখ আর কোথায় আছে? তখন তো আবার চারিদিকে শুধুই ফলের সমাহার। আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু ইত্যাদি। গ্রীষ্মের পুরো ছুটিটাই কেটে যায় আমতলা, জামতলা আর লিচুতলায়।
প্রকৃতির চঞ্চলতা ফেরাতে আবার বর্ষা আসে। ক্ষণে ক্ষণেই আকাশে কালো মেঘ জমে, মেঘ ডাকে। শৈশব নামক ঐ নীল পদ্মের উপর ই যেন বর্জ্যপাত হলো। অকস্মাৎ বিকট শব্দে সাঙ্গ হলো শৈশব কল্পনা।
এখন দিবানিশি ঘরে বাল্ব জ্বলে, নেই সেই হারিকেন। আছে আমোদপ্রমোদ, নেই সেই চড়ুইভাতির সুখ। ফুল মানেই এখন গোলাপ আর রজনীগন্ধা, হারিয়ে গেছে সেই শিউলি ফুল কুড়ানোর সোনালী দিনগুলো। নদীর উপর ব্রীজ তৈরী হচ্ছে, কোথায় সেই ডোঙা আর নৌকা?
এখন নেই সেই বৃষ্টির দিনে কচুপাতা কে ছাতা বানানোর আনন্দ।
তাই এখনও শ্রাবনের এক পশলা বৃষ্টির পর যখন ঐ আকাশে রংধনু ওঠে, ওই রংধনুর মাঝে আমি দেখতে পাই আমার সেই সোনালী শৈশব। বৈশাখের সামান্যতম ঝড়েও এ মন আমার পৌঁছে যায় আমতলায় পাকা আম কুড়াতে। খেতে বসলে ভাতগুলোর দিকে তাকাতেই মনে পড়ে যায় শিউলী গাছটার নিচে ছড়িয়ে থাকা ফুলগুলোর কথা। এখন তো সেই শিউলি গাছটা ও নেই। আমি হারিয়েছি আমার শৈশব আর শিউলি গাছটা হারিয়েছে তার জীবন।
একাকিত্ব যখন হৃদয় ছেয়ে যায় তখনই ভাবি আবার যদি ফিরে পেতাম আমার সেই সোনালী সুখের শৈশব! এ মন যেন বারবার বলে ওঠে ” আবার যাবো শৈশবে “এ যেন এক দিবাস্বপ্ন”।
আবার যাবো শৈশবে
বিজয় পাল
প্রথম বর্ষ, ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
Artwork; এক নারীর গল্প
More Stories
চন্দ্রবোড়া সাপ কামড়ালে কি করা উচিত
সাপ্তাহিক চাকরির খবর ২০২৪
রাসেল ভাইপার কেন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে