নিয়তি
soci,gov,man,
সজীব ঘটক
—————–
বিশ্ববিদ্যালয় আজ প্রায় চার মাস ছুটি হয়েছে। ঘরে বসে থাকতে থাকতে খুবই বিরক্ত লাগছিল, সমস্ত শরীরে যেন প্রচন্ড এক অলসতা বাসা বেধেছে। কোন কাজে মন বসেনা, জীবনটা কেমন যেন খাপছাড়া আর একগুয়ে স্বভাবের হয়ে গেছে। ইচ্ছে করে বাইরে কোথাও ঘুরে আসি। কিন্ত সারা পৃথিবীজুড়ে ভয়ঙ্কর এক মহামারী দেখা দিয়েছে, করোনা। এটা এক ধরনের ছোঁয়াচে রোগ, যার কোন প্রতিশেধক এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি।
একারনেই দেশের সকল স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে। সমগ্র পৃথিবী এই ভয়ঙ্কর রোগের কারনে অচল হয়ে পড়েছে। বিনা কারনে ঘর থেকে বেরোনো নিষেধ করা হয়েছে। তাই মন চাইলেও বাইরে যাওয়ার উপায় ছিলো না! তাছাড়া বাবা-মায়ের কঠোর অনুশাসন তো আছেই।
যাই হোক গত পরশুদিন সকালে খেয়ে দেয়ে যথারীতি মোবাইলটা নিয়ে শুয়ে শুয়ে ভিডিও দেখছি। তখন কাকা এসে বললেন আমাকে একটা কাজের জন্য শহরে যেতে হবে। মনে মনে ভীষণ উত্তেজনা হলেও বাইরে সেটা প্রকাশ করলাম না। কাকা যেতে বলেছে তাই মা-বাবাও আর কিছু বলতে পারলো না।
যাইহোক আমি বাড়ি থেকে বেরলাম। মনে মনে অনেক আনন্দ হচ্ছিল। এতদিন পর চিরচেনা সেই শহরে যাচ্ছি। এই শহরেই আমার কলেজ জীবন শেষ হয়েছে। আমার অনেক পরিচিত বন্ধু-বান্ধবী আছে। অনেক স্মৃতি বিজড়িত এই শহর। শহরে যেতে যেতে পথেই এক বন্ধু, হাবিবকে ফোন করে বললাম আমি আসছি। তুই বের হ। দুইবন্ধু মিলে সেই পুরনো দিনের মতো ঘুরবো। সোহাগ কাকুর চায়ের দোকান, যার দোকানে রোজ সন্ধ্যায় চায়ের কাপে মুখ দিতে দিতে আড্ডা জমতো।
সেই বাঁধাঘাট, যেখানে কেয়া ম্যাডামের কাছে পড়া শেষে আড্ডার জায়গা ছিলো, তাছাড়া আরও অনেক জায়গা ছিলো। আজ আবার সেসব জায়গা যাব। কিন্তু তার ও বাড়ি থেকে বাইরে আসা বন্ধ। তাকেও বাড়ি থেকে বাইরে আসতে দিবে না শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। হতাশ হয়ে আমি যে কাজের জন্য এসেছি তা করতে গেলাম। একটু পরেই হাবিব ফোন করে বললো ওর বাবা অফিস গেলেই মায়ের কাছে কিছু একটা অযুহাত দিয়ে সে ঠিকই চলে আসবে।
যাইহোক মনে কিছুটা ভালোলাগা কাজ করলো এবং আমার কাজ শেষ হতে না হতেই দেখলাম সে হাজির। অনেকদিন পর বন্ধুকে কাছে পেয়ে অনেক আনন্দ লাগছিলো। তারপর দুইজনে মিলে সোহাগ কাকুর দোকান থেকে চা খেলাম। দোকানে অবশ্য কাকু ছিলেন না। তার ছেলে ছিল। তারপর হাবিব আজ আমাকে নতুন একটা জায়গার নাম বললো, চরেরঘাট। বললো জায়গাটা নকি খুবই সুন্দর এবং আজ আমরা ওখানেই যাব।
নামটা আমার পরিচিত মনে হলেও চেনা ছিল না। সেখানে গিয়ে দেখলাম জায়গাটা আসলেই অনেক সুন্দর। নদীর তীরে পাশাপাশি বিরাট দুটো বটগাছ। একটা গাছের নিচে বসার জন্য ইটবালু সিমেন্ট দিয়ে বসার জায়গা বানানো। কিন্তু আমরা সেখানে জায়গা পেলাম না। অন্য বটগাছটা একটু দূরে। একেবারে নদীর কিনারে।
প্রচন্ড রোদে আমরা অন্য গাছের ছায়ায় আশ্রয় নিতে সেদিকে এগিয়ে গেলাম। গাছের শিকড়গুলো মাটি ফুড়ে বেরিয়ে গেছে। তার উপর বসতেও পারবো। ওখানে পাশেই একজন ভদ্রলোক দাড়িয়ে ছিলেন, নদীর স্রোতের দিকে তাকিয়ে কি যেন একটা ভাবছেন। বয়স আনুমানিক ৭০ এর কাছাকাছি। ভদ্রলোকের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় আমি তার দিকে তাকাতেই দেখলাম উনিও আমাদের দিকে মুখ ফেরালেন। চোখে চোখ পড়ে গেল। উনি একটা মিষ্টি হাসি দিলেন।
আমাদের জিজ্ঞেস করলেন,
-বাড়ি কোথায় তোমাদের?
হাবিব উত্তর দিলো। আমি কোন কথা বললাম না। ভদ্রলোককে খুব একটা গুরুত্ব না দিয়ে আমাদের মতো গিয়ে বসলাম শিকড়ের উপর। তারপর গল্প করতে লাগলাম হাবিবের সাথে। লেখাপড়া, দেশের বর্তমান পরিস্থিতি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে। খেয়াল করলাম লোকটা এখনও নদীর দিকে তাকিয়ে কি যেন ভেবেই চলেছেন।
হটাৎ আবার আমার দিকে তাকালেন। আবার চোখে চোখ পড়তেই আমি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম। দেখলাম ভদ্রলোক একটুপর আমাদের কাছে এসে দাড়ালেন। আমি কিছুই বললাম না। হটাৎ তিনি নিজেই আমাদের উদ্দেশ্য করে বললেন,
-তোমাদের মতো বয়স একসময় আমারও ছিলো। কিন্তু আমাদের জীবন ছিলো একটু অন্যরকম। আমি মাঝেমধ্যে যখন এখানে এসে দাড়াই, নদীর দিকে তাকাই। একটা পুরোনো স্মৃতি আমার মনে পড়ে। মনে হয় এইতো এই সেদিন দুপুরবেলার ঘটনা। কিন্তু আসলে ঘটনাটা ছিলো একাত্তরের।
এই শেষ বাক্যটি শোনার সাথে সাথেই আমাদের মনের মধ্যে তার জন্য অন্যরকম একটা জায়গা তৈরি হলো। তার প্রতি আপনাআপনিই আমাদের একটা গভীর শ্রদ্ধা, ভালোবাস কাজ করতে লাগলো। আর হবে না-ই বা কেন! তিনি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষী!
এইবার আমাদের কাছে নিজেদের গল্প গুরুত্বহীন হয়ে গেল এবং তার জীবনের সেই ঘটনা তথা মুক্তিযুদ্ধের সময়ের সেই ইতিহাস জানার জন্য মন ব্যাকুল হতে লাগলো। আমরা বইয়ে অনেক পড়েছি যুদ্ধের সময়কার নানান দুঃখ বিজড়িত ঘটনা। কিন্তু সেসব ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এরকম মানুষের কাছ থেকে শোনার মধ্যে অন্যরকম অনুভূতি আছে। যাইহোক আমি বললাম,
-আঙ্কেল, যদি কিছু মনে না করেন আমরা কি আপনার থেকে ঘটনাটি শুনতে পারি?
তিনি মুচকি হাসি দিলেন। অতঃপর বলতে শুরু করলেন।
-তখন ছিলাম তরুণ, মনের মধ্যে প্রতিশোধের আগুনটাও ছিল প্রখর। একটাই লক্ষ্য দেশকে বাঁচাতেই হবে। প্রান দিয়ে হলেও। আমার টিমও আমার কমান্ড যথাযথ পালন করেছে।
শুনেই বুঝতে পারলাম, ইনি শুধু মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী ই নন, একজন সাহসী কমান্ডার।
আমি আমার দল নিয়ে গেরিলা যুদ্ধ করতাম।
আচ্ছা তার আগে কটা বাজে আমাকে একটু বলো তো। আমার আবার একটু ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। আমার হার্টের বেরাম আছে ।
-১১ঃ৩৬ আঙ্কেল।
-আচ্ছা, ঠিকআছে, এখনও বেশ সময় আছে।
বলি তবে। শোনো, এই বলে তিনি আরম্ভ করলেন,
-আমাদের গ্রামেই ছিল একজন চোর, সে সব হিন্দু বাড়িতে চুরি করতো, আর মেয়েছেলেদের ধরে নিয়ে দিত খানেদের কাছে। পাকসেনারা আসার পর এলাকায় তার অনেক দাপট হয়ে পড়েছিল।
সমস্ত অন্যায় অপরাধ প্রকাশ্যে করে বেড়াতো। কেউ তাকে কিছু বলতে পারতো না ভয়ে। আমি একদিন রাতে আমার দলবলসমেত তাকে ধরে আনলাম। গ্রামের থেকে একটু দুরে ফাঁকা বিলের মধ্যে নিয়ে গেলাম। তারপর তাকে বললাম তার নিজের অপকর্মের জন্য ক্ষমা চাইতে।
কিন্তু প্রায় পনের-কুড়ি মিনিট ধরে তাকে দিয়ে একটাবারের জন্যও ক্ষমা চাওয়াতেই পারলাম না। শেষে আমি নিজের সঙ্গীদের কাছে বললাম তোমরা কি বলো? একে কি ক্ষমা করা উচিত না মেরে ফেলা উচিত? তখন আমি একটা নির্বাচন পদ্ধতি করলাম। বললাম তোমরা যারা মনে করো মেরে ফেলা উচিত তারা পূর্ব পাশে আর যারা মনে কর ক্ষমা করা উচিত তারা পশ্চিম পাশে সরে যাও।
দেখলাম পশ্চিম পাশে আমি এবং আরেকজনসহ মাত্র দুজন আছি, আর বাকি সবাই পূর্বপাশে। তখন আমি পূর্বে অবস্থানকারীদের জিজ্ঞাসা করলাম, তোমরা কেন তাকে মেরে ফেলার পক্ষে? সে অন্যায় করেছে তাই বলে মেরে ফেলা লাগবে! তখন তারা সবাই উত্তর দিল আপনি ওকে কতোবার ক্ষমা চাইতে বললেন, কিন্তু সে একটিবার মুখ থেকে ক্ষমা শব্দটি উচ্চারণ পর্যন্ত করল না, তাছাড়া সে যে অন্যায়, যে পাপ করেছে, তাতে তার মৃত্যু হওয়ায় উচিত। আনিসের বোনের বিয়ে ঠিক হয়ছিল।
ওই শয়তানের সাহায্যে পাকসেনারা মেয়েটাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে..। পরেরদিন খালের পাশে তার লাশ পাওয়া যায়, কী বীভৎস! আমাদের রতনকে ধরিয়ে দিয়েছিল এই হারামজাদা। আরও অনেক হত্যায় সাহায্য করেছে। ব্যাস, আর কোনো কথা নয়।।
সকলের মতানুসারে তাকে গুলি করে বিলের পানিতে ঠেলে ফেলে দেওয়া হলো। দেখলাম সে খুবই কষ্ট পাচ্ছিল। কচুরিপানার ঝোপের মধ্যে ফেলা হয়েছিল। সেখানে সে কোনভাবে মুখটা বের করে গোঙাচ্ছিলো, সে মর্মান্তিক দৃশ্য দেখা যায় না। তারপর তাকে বন্দুক দিয়ে কচুড়ির ঝোপের মধ্যে ঠেলে দিয়ে চলে এলাম। এই বলে তিনি থামলেন, পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে সময় দেখলেন।
তারপর বললেন, এই নদীর সাথে আমার অনেক স্মৃতি আছে। ভুলতে পারি না। পৃথিবীর প্রত্যেক পিতামাতার কাছেই তাদের ছেলেমেয়ে সবথেকে প্রিয় হয়। মাতাপিতার মতো নিঃস্বার্থ ভাবে তার সন্তানকে আর কেউ ভালোবাসতে পারে না। আমাকেও আমার পিতামাতা তেমনই ভালোবাসতো। আরেকটা ব্যক্তিও আমাকে খুবই ভালোবাসতেন তিনি ছিলেন আমাদের ফুটবল খেলার কোচ। যিনি খেলা শেখাতেন আরকি। তার বাড়ি ছিলো আমাদের পাশের গ্রামেই। একটা কথা বলে রাখি আমি কিন্তু তখন ভালো ফুটবল খেলতে পারতাম।
একসময় বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে ফুটবল খেলেছি। কিন্তু সেটা অনেক আগের কথা, এখনকার কেউই সেটা মনে রাখেনি। তোমরাও একসময় দেখবে এখনকার যেসকল নামকরা খেলোয়াড়রা আছে বিশ-চল্লিশ বছর পরে তোমরাও তাদের ভুলে যাবে।
-হ্যা। তাতো ঠিকই। সময়ের সাথে সাথে এখনকার খেলোয়াড়দের বয়স হবে, নতুন নতুন খেলোয়াড় আসবে, তাদের ভীড়ে এখনকার সব হারিয়ে যাবে।
-হুম। ঠিক ই বুঝেছো। তো আমার যে কোচ ছিলেন, তার কাছ থেকে আমি অনেক ভালোবাসা পেয়েছি। তিনি নিজের হাতে অনেক মেডেল আমাকে পরিয়ে দিয়েছেন। আমার মাথায় হাত দিয়ে অনেক আদর করেছেন।
তিনি খেলোয়াড় হিসেবেও ছিলেন অসাধারন। তাছাড়া তিনি একজন আনসার সদস্য হিসেবে কাজ করছেন। অনেক শক্ত সামর্থ্য একজন মানুষ ছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার জাতীয় দলে খেলার ঘটনা তিনি শুনে যেতে পারেনি।
বলতে বলতে ভদ্রলোকের চোখে জল চলে এসেছে। চোখের জল মুছতে মুছতে বললেন, যাইহোক অন্যদিকে না গিয়ে ঘটনায় আসি। ১০ই ডিসেম্বর ১৯৭১, নড়াইল স্বাধীন হয়ে গেছে। দলে দলে খান সেনারা সবাই আত্মসমর্পণ করতেছে। আমিও সেখানেই ছিলাম, রতনগঞ্জে। আমরা আত্মসমর্পণ অস্ত্র সংগ্রহ করতেছিলাম।
বেলা আনুমানিক ২ টার সময় আমাদের খাবার খাওয়ার জন্য ডাকতে এলো আমাদের দলের সবচেয়ে ছোট্ট সদস্য, নাম ছিলো সুমন। ওর বয়স তখন প্রায় দশ। আলাদাতপুরে খাবারের ব্যবস্থা হয়েছে। আমরা দ্রুত পৌছানোর জন্য এই নদীর তীরের রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিলাম। প্রায় পনের-বিশজন আমরা। আমি সবার সামনে। যেহেতু আমি দলনেতা ছিলাম, তাই সবসময়ই আমি সামনে থেকে সকলকে পরিচালনা করতাম, দিকনির্দেশনা দিতাম। তখন কিন্তু এখনকারমতো এতো জনবসতি ছিলো না। জনসংখ্যা কম ছিলো।
তখন এখানে কেউ আড্ডা দিতে আসতো না, ওখানের ওই বসার জায়গাটাও ছিলো না। এখানে ছিলো বিশাল বন। তো সেদিন এই বনের ভিতর দিয়ে আমারা এগোচ্ছি। যখন ওই বটগাছটার কাছাকাছি এসেছি তখন হটাৎ কিছুটা সামনে কেমন একটা শব্দ শুনতে পেলাম, সামনে কয়েকটা ছোট ছোট বন্য গাছ নড়ে উঠলো। যেন হাওয়ায় দুলে উঠলো সামনের ওই গাছগুলো।
আমার কেমন যেন মনে হল সামনে কেউ একজন ওখানে আছে। সাথে সাথে আমি সকলকে সতর্ক করে দিলাম, আর পজিশন নিয়ে দাড়াতে বললাম। সকলেই বন্দুক বাগিয়ে পজিশন নিলো। আমি চিৎকার করে বললাম, কে? কে ওখানে? সামনে আসুন। নাহলে এখনি আপনার প্রান যাবে। কিন্তু কোন সাড়া পেলাম না। অপারেশন এর ভাষায় এই পদ্ধতিকে বলে হোয়াইট এইম।
অর্থাৎ সম্মুখে কিছু আছে কিনা তা নিশ্চিত না হয়েও শূন্যে লক্ষ্য করে পজিশন নেওয়া।
যাইহোক আমি আবারও একবার এবং তারপর আরও একবার চিৎকার দিলাম। কিন্তু তবুও কোন সাড়া পেলাম না। তারপর একমুহূর্তের মধ্যে সামনের ঝোপের মধ্যে থেকে কেউ একজন বিদ্যুৎ গতিতে দৌড় দিল। আমি তখনও চিৎকার করে বলছি থামুন, দৌড়াবেন না, আপনার কোন ভয় নেই, আমরা আপনার কোন ক্ষতি করবো না।
কিন্তু কে শোনে কার কথা। এক দৌড়ে গিয়ে তিনি নদীতে ঝাপিয়ে পড়লেন। দেখলাম তার মুখটা গামছা দিয়ে ঢাকা, এবং হাতে একটা এসএমজি। নদীতে ঝাপিয়ে সে প্রাণপনে সাঁতরাচ্ছে। আমরা কেউই তখনো গুলি ছুড়ি নি। আমি কাউকে গুলি করার অনুমতি দেয়নি তখনো। আমি আবার চিৎকার করলাম থামুন, থেমে যান আর সাতরাবেন না। কিন্তু তিনি তবুও আমার কথা শুনলেন না, প্রাণের ভয়ে ছুটছেন তিনি, কারও কথা তখন শোনার সময় নেই।
অবশেষে তিনি যখন প্রায় ওপারে পৌঁছে যাবেন তখন আমি সকলকে ফায়ার করতে বললাম। সবাই মিলে প্রায় পনের রাউন্ড গুলি ছুড়লাম। কারটা যে লেগেছিল নাকি লাগেনি তা বোঝা যায়নি এত দুর থেকে। তারপর দেখলাম উনি কোনভাবে পানি থেকে কূলে উঠেই উবুর হয়ে পড়ে গেলেন, আর উঠলেন না।
এইটুকু বলে ভদ্রলোক বড় নিশ্বাস নিলেন।আমি জিজ্ঞেস করলাম,
-তা আঙ্কেল লোকটা কে ছিলো? জানতে পেরেছিলেন? ওপারে দেখতে গেছিলেন নাকি? নাকি যাননি?
-হ্যা, জানতে পেরেছিলাম। পরে আমরা নৌকা নিয়ে ওপারে গিয়েছিলাম। দেখি দুটো গুলি খেয়ে মরেছেন, বুকে একটা আর মাথায় একটা লেগেছিল। যাইহোক আমরা তার মুখের গামছা খুলেছিলাম দেখার জন্য তিনি কে।
মুখটা দেখার পর কষ্টে আমার বুক ফেটে যেতে লাগলো, আমি কাঁদতে শুরু করেছিলাম। আবারও চোখের জল মুছলেন তিনি এবং বলতে থাকলেন। আমার দলের সবাই বলতে লাগলো, কি ব্যাপার, একজন দেশদ্রোহী রাজাকারের মৃত্যুতে আপনি কাঁদছেন কেন? তোমাদেরও মনে একই প্রশ্ন আসছে না? কেন কাঁদছিলাম? কেন কষ্ট পাচ্ছিলাম?
-আচ্ছা তুমি হলে কি কাঁদতে না? যে আমাকে এত স্নেহ করতো, কতো আদর করে মেডেল পরিয়ে দিয়েছেন তিনি, আর তিনি নাকি আমার নেতৃত্বেই মারা পড়লেন? আমার কাছেই তার মৃত্যু হলো?
আমরা কিছুই বলতে পারলাম না। মনে মনে আমাদেরও অনেক কষ্ট হতে লাগলো। হাবিব হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, তা কাকু আপনার ফুটবলের কোচ রাজাকার কেন হয়েছিলেন?
-কি জানি? আল্লাহ হয়তো ওটাই তার নিয়তে রেখেছিলেন।
আমি এখনও ভাবি সেদিন যদি তিনি আমার কথা শুনতেন, যদি পালানোর চেষ্টা না করতেন, তাহলে উনাকে ওইভাবে মারা যেতে হতো না। তখন আমি বললাম, আসলে আঙ্কেল যার কপালে যা থাকে তা হতে দিতে হয়, তা আটকানোর ক্ষমতা আপনার-আমার নেই।
-হ্যা, ঠিকই বলেছো। কি জানি এইসকল কাজের জন্য আল্লাহ আমার কি শাস্তি দিবেন।
-আপনাকে কেন শাস্তি দিবেন আল্লাহ। আপনি দেশের জন্য লড়াই করেছেন, দেশের মানুষকে অন্যায়-অত্যাচারীদের থেকে রক্ষা করতে আপনি লড়াই করেছেন।
আবার দীর্ঘশ্বাস।। আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম,কিন্তু তার আগেই তিনি বললেন, আমাকে এখন যেতে হবে। যাইহোক তোমরা এতক্ষণ ধৈর্য্য নিয়ে আমার কথা শুনলে, আমার খুব ভালো লাগছে। এতক্ষণ আগ্রহ নিয়ে আমার জীবনের গল্প শোনার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
-না না আঙ্কেল, আমরা আপনার কাছে কৃতজ্ঞ,আপনি একজন সাহসী কমান্ডার। আপনাকে স্যালুট। আপনার মত সাহসী মানুষদের কারনেই আমরা আজ এই স্বাধীন বাংলায় বাস করতে পারছি। দোয়া করবেন যেন এই স্বাধীন দেশের একজন সুনাগরিক হয়ে দেশকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে পারি।
-অবশ্যই, অবশ্যই দোয়া করি। তোমাদের এই কথাগুলো শুনে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যে আনন্দ হচ্ছে তা আর বলে বোঝাতে পারছি না। আল্লাহ যদি আবার কোনদিন আমাদের দেখা করায় সেদিন আরও অনেক কথা হবে। এখনকারমতো আমি আসি। ভালো থেকো তোমরা।
-হ্যা আঙ্কেল আপনিও ভালো থাকবেন। বলে সালাম করলাম।
উনি চলে গেলে মনে পড়ল তাড়াহুড়োয় ওনার নামটাই জিজ্ঞেস করা হয় নি। তবে হ্যা, মনে মনে নাম দিয়ে দিয়েছি- ক্যাপ্টেন ব্রেভ, তাছাড়া মনে মনে অনেক গর্ববোধ হতে লাগল উনার জন্য, এদেশের জন্য। মনে মনে অনেকটা শক্তি আসল দেশের জন্য কিছু করতেই হবে। দেশকে বিশ্বের বুকে সেরা তালিকায় এগিয়ে নিতে হবে।
নিয়তি
সজীব ঘটক
প্রথম বর্ষ, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং,
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রকাশিত: ‘বর্ণালী’ মাসিক ম্যাগাজিন, অক্টোবর সংখ্যা, ২০২০
আমি দেখেছি
More Stories
চন্দ্রবোড়া সাপ কামড়ালে কি করা উচিত
সাপ্তাহিক চাকরির খবর ২০২৪
রাসেল ভাইপার কেন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে